ঘোড়ার সহিস অর্জুন আর অলীক চৌখাম্বার গল্প

অর্জুন সিং ফোন করল হঠাৎ। উত্তরাখণ্ডে চোপতা থেকে তুঙ্গনাথ ঘোড়া-রুটের সহিস অর্জুন সিং। বদ্ধ উন্মাদ। দেখা হওয়ার পর আমাকে নাকি দিলদরিয়া লেগেছিল অর্জুনের। ১৪০০ টাকা দিয়ে কেনা চাইনিজ ফোনে সেভ করে নিয়েছিল আমার নম্বর। সে প্রায় বছর খানেক আগের কথা। আজ হঠাৎ ফোন। নেশা জড়ানো গলায় স্থানীয় উচ্চারণে যা বলল তার অর্ধেকই বুঝলাম না। কিন্তু থম মেরে থাকা সন্ধেটা ভালোলাগায় খুলে গেল নতুন করে। ঠিক যেভাবে এমনই এক সন্ধেয় টানা তিনদিনের বৃষ্টির পর সব পূর্বাভাস মিথ্যে করে দিয়ে আমাদের চোখের সামনে খুলে গেছিল চৌখাম্বা, কেদার, বাঁদরপুচ্ছের শৃঙ্গ। অর্জুনের নেশা চড়ে গেল আমাতেও। রাত বন গ্যয়া...

অর্জুনের সঙ্গে আলাপ চোপতায়। আগের দুদিন ভারী বৃষ্টির পর সেদিনটাও ভাসবে বলেই মনে হচ্ছে। আমরাও তাড়াতাড়ি তৈরি হচ্ছি তুঙ্গনাথে ওঠার জন্য। অনেকটা চড়াই। রাস্তায় বৃষ্টি এলে বিপদ। মাল উঠবে ঘোড়ায়। আমাদের দলের সবথেকে ভারী বস্তুটি অর্থাৎ আমার মাকে নেওয়ার জন্যেও ঘোড়া লাগবে। আরও কয়েকজন সহিসের সঙ্গে অর্জুনও তাই সক্কাল সক্কাল এসে হাজির আমাদের হোম স্টে-র সামনে। মাত্র দু-তিনখানা ঘোড়া লাগবে শুনে ও খুবই মনমরা। ওর ঘোড়ার নম্বর আসার আগেই আমাদের প্রয়োজন মিটে যাবে। “রাস্তা বড়িয়া। ডরনেকা নেহি। ঘোড়েপে জলদি পঁওছ যায়েঙ্গে। অওর এক ঘোড়ে লে লিজিয়ে।”-- বলে কানের পোকা বের করে দিতে থাকে আমাদের। হাড় জিরিজিরে চেহারা। দেখলেই মনে হয় নেশা করে। আর খুব হাসে। নিজের কথায় নিজেই আমোদ পায়। যাহোক, খানিক পরেই ও বুঝে যায় আমরা ওকে খুশি করতে পারব না। কোয়ি পরোয়া নেহি-- ও বেরিয়ে পড়ে অন্য পার্টি ধরতে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাকে পায় বলতে থাকে, চোপতায় পড়ে থেকে কী করবেন? ওপরে চলুন। তুঙ্গনাথজীর দর্শন করবেন। ক্লিয়ার স্কাইতে চৌখাম্বা দেখবেন। ফুল সুইজারল্যান্ড। খেয়াল করেছিলাম, সহিসদের মধ্যে একমাত্র অর্জুনই তুঙ্গনাথের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলছে। একজন জুটেও গেল। তুঙ্গনাথজীর মতোই বিরাট কলেবর এক মানুষ। মাঝরাস্তায় চা খাবার জন্য যখন দাঁড়িয়েছি, তখন দেখি অর্জুনের ঘোড়া ধরে ফেলেছে আমাদের। দুধ সাদা ঘোড়া। অর্জুন বলেছিল-- ঘোড়ী। নামটা মনে পড়ছে না কিছুতেই।

তুঙ্গনাথে পৌঁছে ফের দেখা হয় অর্জুনের সঙ্গে। দিগন্তবিস্তৃত সবুজ বুগিয়াল, তুলোর মতো মেঘ আর আকাশজোড়া গাড়োয়াল রেঞ্জকে পাশে রেখে ফের পার্টি খুঁজছে অর্জুন। বয়ান বদলে গেছে--- “এখানে কীভাবে পড়ে থাকবেন। রাতে বৃষ্টি হবে। ঠান্ডা হবে। তারচেয়ে চোপতা অনেক ভালো। আর, এখান থেকে যা দেখছেন চোপতাতেও সেই একই ভিউ।” এ তো আজব লোক। চেঁচাতে চেঁচাতে ফের পার্টি পেয়ে যায় অর্জুন। আর সন্ধের ঠিক আগে দেখি একজন বুড়োকে নিয়ে সে ফের উঠে এসেছে তুঙ্গনাথে। ওকে দেখে বাকি সহিসরা হাসাহাসি করে। আমাকে দেখে একজন বলে—“ও পাগল। নিজের ঘোড়া নেই। ঘরও নেই। দিনে তিন-চারবার ওঠে-নামে। রাতে নেশা করে পড়ে থাকে।” এসব লোকদের আমার চিরকালই ভালো লেগে যায়। ভাবি, আলাপ করব।

সন্ধের শীতটা একটু কড়া হতেই গিয়ে বসি অর্জুনের পাশে। আস্তাবল মতো একটা ঘর। সামনে খোলা। রাতে যে সহিসরা ফিরতে পারে না, তারা গাদাগাদি করে থাকে ওখানে। ঘোড়ার গায়ের গন্ধ, বর্জ্যের গন্ধ, বৃষ্টি-ভেজা মাটির গন্ধ আর স্যাঁতস্যাঁতে চটের গন্ধ এক-জট হয়ে মিলেমিশে আছে। সামনে খোলা থাকলেও জায়গাটা খানিক গরম। বুরাচের চোলাই খেয়ে অর্জুনের চোখ লাল। গল্প শুরু হয়। জানতে পারি, ওর নিজের ঘোড়া ছিল। বউকে গয়না গড়িয়ে দেবে বলে ঘোড়া বেচে দেয়। কিন্তু, তাতে লাভ? ওর একমাত্র দোষ ও নেশা করে। সেই কারণেই নাকি বউ ওকে ছেড়ে পালিয়েছে। ও মরদের বাচ্চা। খোঁজেনি। কাঁদেওনি। শুধু বেচে দেওয়া ঘোড়াটাকেই দিনে ৪০০ টাকা ভাড়ায় নিয়ে বেরোয়। ঘোড়াটাও ওকে ছাড়া থাকতে পারেনা। এ ভালোই হয়েছে। “নিজের ঘোড়া না থেকেও আছে। নিজের বউ থেকেও নেই।” বলে হাসতে থাকে অর্জুন। হঠাৎ বলে ওঠে--- “আপনারা সমতলের লোকরা খুব চুতিয়া।” এ আমার মনের মতো কথা। সায় পেয়ে ঘাড় নাড়তে থাকে অর্জুন। বলে, মাফিয়ারা উত্তরাখণ্ডের জঙ্গল নষ্ট করে দিল কাঠ কেটে, আগুন লাগিয়ে। শালা তুঙ্গনাথ, কেদারনাথ সব ঝুটা। নাহলে এখানে বন্যা হয় কেন? আগুন লাগে কেন? মানুষ মরে কেন?

তুঙ্গনাথে থাকাকালীন দুদিনে অর্জুন বারবার ওঠে আর নামে। নামার আগেরদিন বলি মাকে ওর ঘোড়ায় নামাব। “বিলকুল বিলকুল” বলে কথা দিয়ে পরের দিন ভোরেই ও যথারীতি ভুলে অন্য পার্টি নিয়ে নেমে যায় নিচে। মাঝরাস্তায় ফের দেখা। ও তখন আরেকটা পার্টি জুটিয়ে উঠছে। যখন মনে করিয়ে দিই ওরই আমার মাকে নামানোর কথা ছিল--- ও উপত্যকা উজাড় করে হাসে। হঠাৎ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে—“হুশ। ও দেখিয়ে মোনাল।”-- ময়ূরের মতো মোনালকে দশ-বারো হাত দূর থেকে দেখতে দেখতে আমার মনে হয় এসবই অলীক। এসব কিছুই ঘটছে না আমার জীবনে। ঘটবেও না আর...

সেই অর্জুন আজ ফোন করেছিল। সমতলের এই ‘চুতিয়া’ মানুষটাকে তার মনে পড়েছে হঠাৎ। ফোনের ঐপার থেকে আমি গন্ধ পাচ্ছিলাম বুরাচের। আমরা বলি রডোডেনড্রন। শব্দ পাচ্ছিলাম বৃষ্টির আর দেখতে পাচ্ছিলাম অর্জুনকে ক্রমশ কালো করে দিয়ে পিছনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে চৌখাম্বা। অলীক। দিলদরিয়া।

More From Author See More