নামের মধ্যে জীবন-মৃত্যুর এক চক্রাকার আবর্তন। হ্যারি পটারের প্রাণ ফিরিয়ে দেয় গ্রিক পুরাণের যে আগুনপাখি, তার কথাই যেন আমাদের লোকগানে – ‘যেথা হইতে আসে পানি সেথা আবার চইল্লা যায়’। করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের পরিসংখ্যানে এই মুহূর্তে শীর্ষে থাকা যে দেশ, ফিনিক্স সেই দেশটারই বেশ সাধারণ দেখতে একটা শহর। এমনিতে গবেষণার কাজে পশ্চিমের মরুভূমিতে যাওয়া হয় একাধিকবার। বিদেশ থেকে কনফারেন্সে ডাক পাওয়া, সেও এক মরুভূমির দেশ থেকেই, অ্যারিজোনা। প্রকৃতি তার রুক্ষতা-শূন্যতার মধ্যেই যেন ঠেলে দেয় বারবার। কিন্তু প্রতিবারই সেই মরুশহরগুলোর সঙ্গে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিদেশি শহরটার সঙ্গে আমার আত্মীয়তা ঘটল সেই ছোট্ট পরিবারটার সৌজন্যে। পূর্ব পরিচয় ছিল না, ভিনদেশি অতিথি হিসেবে কয়েকটা দিন মাত্র থাকতে গিয়েছিলাম। কিন্ত সেখানে গিয়ে যে পরিবার পেলাম, দেখলাম, তা শুধু রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠেনি। ওদের কাছে পরিবারের সংজ্ঞাটা খানিক বৃহত্তর। জেসন ও লিজ, দুজনেই পেশায় নার্স, সঙ্গে সমাজকর্মীও। আর ছিল লিজের মা, আমাদের আদরের ঠাকুমা।
সেই বৃহত্তর পরিবারে কখনও সদস্য হয়ে আসে একা বিপন্ন মহিলা, কখনও একটা গোটা উদ্বাস্তু সংসার। আবার কখনও আমাদের মতো কনফারেন্স-সফরকারী। শুধু আমাদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য এক জায়গায় – তারা বিপদগ্রস্ত, সন্ত্রস্ত। তেমনই একজনকে আমরা পেয়েছিলাম আমাদের সহ-অতিথি হিসেবে। প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা একটা ছেলে। বয়স মাত্র তেরো। দু’চোখে মায়ায় ভরা চাহনি কোনোদিন ভোলার নয়। প্রথমে ভাবছিলাম লাজুক বোধহয়, তারপর দেখলাম তা নয়। জেসনের মুখ থেকে শুনলাম ও নিজের জন্মস্থানে নিজের আত্মীয়দের কাছ থেকেই প্রবল নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। এখনও ওর চোখেমুখে সেই আতঙ্কের ছাপ। কারোর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না, মোবাইল ক্যামেরায় নিজেকে দেখলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ও রিফিউজি। ইংরাজি বলতে এমনকি বুঝতেও পারে না। দ্বিধা কাটিয়ে, ইশারায় বা ভাঙা ভাঙা অক্ষরে লিখে আমাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করত। বলেছিল ও ফুটবল ভালোবাসে। এই লকডাউনের কারণে নিজের বাড়িতে ঘরবন্দি হয়ে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠি, তাও বাবা-মায়ের নিরাপদ আশ্রয়ে। তাহলে এই ভয়াবহ সময়টায় কেমন আছে ও? কোনো এক অজানা আতঙ্কে আমি সে কথা কখনোই জানতে চাই না। ওর প্রিয় ফুটবলও যে নেই এখন। কিন্ত কল্পনা করি, একদিন ভৃগুর মতোই ওর জীবনেও কোনো অনুসূয়া নেমে এল ‘কোমল গান্ধার’-এর সুরে। গঙ্গার পাড়ের রোম্যান্টিসিজম ওদের টেম্পে লেকের ধারে আমি পাইনি ঠিকই, কিন্তু ভাবতে দোষ কী যে, ‘দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি’ হয়ে, ওরা সেই রোম্যান্টিসিজম খুঁজে পাচ্ছে। লাইট রেলে যেতে যেতে ওরা হয়তো ভাগ করে নিচ্ছে নিজেদের একাকিত্ব আর হারানোর যন্ত্রণা।
এমন বহু মানুষ এবং পরিবারকে নানাবিধ কারণে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে ওই মুলুকে আসতে হয়। তারপর তাদের মধ্যে অনেকেরই কয়েকদিনের আশ্রয় হয়ে ওঠে জেসন-লিজদের ছিমছাম গৃহকোণ। ওদের রেফ্রিজারেটরের গায়ে অপটু হাতে আঁকা কিছু ছবি ছিল। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি, এমনই এক পরিবারের একটি সাত বছরের মেয়ের শিল্পকর্ম সেগুলো। তার বাবা-কাকারা তখন ডিটেনশন ক্যাম্পে। এই বাড়িটাকে সে তার সারল্যে আর দুরন্তপনায় কীভাবে ভরিয়ে রাখত সেই গল্প শুনছিলাম। বছর খানেকের বেশি সময়ের আইনি টানাপোড়েন, তারপর ফিরে যাওয়া। বেশ কয়েক বছর আগের অতিথি ছোট্ট সেই মেয়েটার দৌরাত্ম্যের চিহ্ন, আজও কী সযত্নে রাখা বাড়িটায়। মহামারীর সময়ে অতি আদরে থাকা শিশুর দেওয়ালের আঁকিবুকি হোক অথবা জন্মভিটে উচ্ছেদের পর আশ্রিত মেয়ের হাতে আঁকা ছবি, অবিকৃত শিশুমনের যে সৃষ্টি, তার দিকে চেয়েই যেন কবি বলেন – ‘পাথর করে দাও আমাকে নিশ্চল/আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’
‘আমরা ভাগ্যবান যে আমাদের পরিবার আছে, মাথার উপরে ছাদ আছে, কখনও বাস বা ট্রেনের ছাদে বসে নিজের জন্মস্থান ছেড়ে কোথাও আমাদের যেতে হয়নি’ – ঠাকুমা বলেছিল সেদিন। তবু্ও কত রকমের অভাববোধ আমাদের। এই প্রচার-সর্বস্ব সময়ে যখন আমরা ভালো জামা পরলে, ভালো খাবার খেলেও, তা চেনা-অচেনা মানুষকে দেখানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ি, তখন প্রশ্ন জাগে, কীসের তাগিদে মাঝরাতে বিপদে পড়া ভিনদেশি মহিলাকে নিয়ে আসতে ওরা ছুটে যায় এয়ারপোর্টে। আরও এক রিফিউজি মহিলাকে কয়েক দিন আশ্রয় নিতে দেখি ঐ ছিমছাম বাড়িটায়। ওরা এমন বহু মানুষকে বুকে টেনে নিয়েছে। তাদের কী ভীষণ স্নেহে আগলে রাখছে আমি তার কিছুমাত্রই দেখতে পেয়েছি। বিভিন্নভাবে সাহায্য করে কখনও তাদের নিজেদের দেশে পাঠানো, কখনও বা ওখানেই থাকার বা কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া। প্রয়োজনে ওরাও নিশ্চয়ই রাস্তায় নামে। ‘Women Are Watching’, ‘Stand Up Resist Hate’, ‘Abortion is a Human Right’, ‘Together We Rise’, ‘End Wars Now’, এমন বিভিন্ন স্লোগান-লেখা প্রায় দুশোর কাছাকাছি ব্যাজ ওদের বাড়িতে দেখেছিলাম। ওদের ওই বৃহত্তর সংসারে এখন আরও একজন সদস্য বেড়েছে। সদ্যই একটা মিষ্টি, ফুটফুটে ছেলের জন্ম দিয়েছে লিজ। কিন্তু তাকে নিয়ে আনন্দে মেতে থাকবার ফুরসত কোথায় এখন! করোনার প্রকোপ ওই শহরটায় তেমন ভাবে পড়েনি, তাই লস এঞ্জেলস-এর হাসপাতালে কাজ করতে চলে যেতে হয়েছে জেসনকে। সামাজিক কর্তব্যের কাছে ছেলেকে না দেখে থাকার কষ্টকেও ভুলে থাকতে হয় তাকে।
লস এঞ্জেলসের হাসপাতালের দুর্বিষহ অবস্থা এখন। ফিনিক্সেও যতদিন ছিল জেসন, পরিবারের থেকে দূরে আইসোলেশনেই থাকতে হত। আমার ‘How are you now?’-এর জবাবে ওর ‘I miss them’-এর ছোট্ট প্রত্যুত্তরের পর কোনও কথা এগোয় না আর। আমি কোনও জবাব খুঁজে পাই না। আমাদের দেশে ডাক্তার, নার্স, সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক নানা সংস্থা একসঙ্গে কাজ করছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কোনো সংকট আমরা এখনও পর্যন্ত অনুভব করিনি, তা শুনে বেশ নিশ্চিন্ত হয় সে। কিন্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত মানুষের দিন গুজরান যেভাবে হচ্ছে এদেশে, সেকথা আমার আর বলা হয়ে ওঠে না। পশ্চিমের মরুভূমিতেও কাজ করার সূত্রে কত মানুষ, কত পরিবারের সান্নিধ্যে এসেছি, তাদের আতিথেয়তায় যে আন্তরিকতা দেখি, তেমনই আন্তরিকতা পেয়েছি সুদূর বিদেশেও। সবুজে আর জলে পরিপূর্ণ যে মরুদ্যানের স্বপ্নে বিভোর থাকে রুক্ষ মরুভূমির বুক, এই পরিবারেরা পৃথিবীর বুকে যেন সেইসব স্বপ্ন সত্যি করতেই নেমে আসে।
ফিনিক্সের ওই কয়েকটা দিনের কথা ভাবতে ভাবতে আরও এক গ্রিক পৌরাণিক চরিত্রের কথা মনে পড়ে আমার। স্টাইক্স। তার সঙ্গেও জড়িয়ে জীবন-মৃত্যুর ক্ষণস্থায়িত্ব। আমাদের যেমন বৈতরণী, গ্রিক পুরাণেও জীবিত ও মৃতের মাঝের একটা নদী হল স্টাইক্স। সেই নদীর নামেই জার্মান সিনেমাটা। জাতীয় সঙ্গীত এবং ‘হবে জেইউ বা জেএনইউ’-এর মতো টিটকারি – কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আমাদের দ্বিতীয় ছবি দেখা শুরু এমনভাবে। একটা মেয়ের একক অভিযানের দীর্ঘ-লালিত স্বপ্নের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে ছিল রিফিউজি বোঝাই জাহাজের মানুষের আর্তনাদ। ক্ষমতাশীলের উদাসীনতার সামনে সাধারণ মানুষের অসহায়তার চিরাচরিত চিত্র আঁকা হয়েছিল সেখানে। বাঁচাতে না পারলেও শেষ না দেখা অবধি একা মেয়েটার লড়ে যাওয়া।
ভূবিজ্ঞানের হিসাব বলে, আর হয়তো মাত্র আট মিলিয়ন বছর। তারপর হয়তো মানবশূন্য হতে পারে এই গ্রহ। আমার কাছে এই সংখ্যা তাৎপর্যের, ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যেতে দেখেছি বহু প্রাণীকে। সেটাই প্রকৃতির নিয়ম। এই মহামারী তেমন কোনো ধবংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে, ভূবিজ্ঞানের হিসাবে তা বলা যায় না। আর মিলিয়ন বিলিয়নের হিসাব তো মানুষ এমনিই হেসে উড়িয়ে দেয়। তবে একথা উড়িয়ে দেওয়া যায় কি যে, সত্তর মিলিয়নের বেশি মানুষ এই বর্তমান বিশ্বে উদ্বাস্তু পরিচয়ে বেঁচে আছে এবং তাদের মধ্যে অর্ধেকের বয়স আঠেরোর নিচে? মহামারী, লকডাউন, সোশ্যাল ডিসটান্সিং, কার্ভ ফ্ল্যাটেনিং, এসব খবর পৌঁছচ্ছে তাদের কাছে? নাকি দু-একটা ওসব লোক মরে গেলে পৃথিবীর জনসংখ্যা বেশ কমবে মেনে নিয়ে, ওদের খবর না জানতে চাওয়াই ভালো বলে মনে হচ্ছে?
আর আমাদের রাষ্ট্র, যে নাগরিকের মধ্য থেকে উদবাস্তু খু্ঁজে বের করার আইন প্রণয়ন করেছিল, তাদের একঘরে করার কারখানা বানাচ্ছিল, সে এখন মুখোশে মুখ ঢেকেছে। নাগরিকত্বের প্রমাণ দেখতে চাওয়া সরকারি চাকুরের পরিবর্তে বাড়ি বাড়ি এখন পৌঁছে যাচ্ছে থার্মাল ডিটেক্টর হাতে স্বাস্থ্যকর্মী, চাল-ডাল-আলু নিয়ে পুলিশ অথবা কোনো স্বেচ্ছাসেবক। তার প্রিয় সন্তানকে প্রকৃতি এমন কঠিন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যে ফেলবেই বারবার, তা কি এবার বুঝতে পারছে ডারউইনকে অস্বীকার করা দেশনেতারা? জননী বিশ্রাম চায়, সে জিরিয়ে নিক একটু। কিন্ত অসুখ যখন পাড়ার সবজি-বিক্রেতা ভাইটির কাছে এসে পৌঁছোয়, বারবার মনে হয়, অনেক কাজ যে বাকি রয়েছে আমাদের, জেসনদেরও। হরপ্রসাদ যতই বলে যান, ‘গড্ডলিকাপ্রবাহই সত্য’, এ কথা আমি বিশ্বাস করতে পারি না। অর্থনীতি ধসে পড়া, বিপুলসংখ্যক মানুষের কাজ হারানোর ভবিষ্যদ্বাণীই পাই।
তবু অসম্ভবের দাবি করা মন এই আকালেও স্বপ্ন দেখে, যে অর্থ ব্যয় করে দেশের নাগরিকপঞ্জি আর রামমন্দির তৈরি হওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল, মহামারী-পরবর্তী দেশে সেই অর্থ চলে যাচ্ছে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল ফেরাতে। যেসব শ্রমজীবী মানুষেরা টেনে নিয়ে যান সভ্যতার চাকা, তাঁরা সম্মানের পারিশ্রমিক পাচ্ছেন, সমস্ত সম্পদের সুষম বন্টন করার দিকে নজর দিচ্ছেন আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এবং দেশের কোনো গবেষণাগারে অর্থ আর পরিকাঠামোর অভাবে কোনো বৈজ্ঞানিককে কাজের সঙ্গে আর আপস করতে হচ্ছে না।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)