২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিক। ৫ হাজার ও ১০ হাজার মিটার দৌড়ে সোনা জিতে চর্চায় উঠে এসেছিলেন ব্রিটিশ দৌড়বিদ মহম্মদ, ওরফে মো ফারাহ। ২০১৬-র বেজিং অলিম্পিকেও এই দুই বিভাগে সোনা এনেছিলেন তিনি। তবে আদতে তাঁর নাম হুসেন আবদি কাহিন। শৈশবে সোমালিয়া থেকে তাঁকে পাচার করা হয়েছিল ব্রিটেনে। পাচারকারীরাই মৃত এক কিশোর ‘মহম্মদ ফারাহ’-র নথি ব্যবহার করেছিল তাঁকে পাচারের সময়। ব্রিটেনে এসে হাড়-ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়েছে তাঁকে। শেষে দৌড় হয়ে ওঠে তাঁর মুক্তির পথ…
সপ্তাহ দুয়েক আগে সামনে আসে এই কাহিনি। বিবিসি ডকুমেন্টারি সিরিজের এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বয়ং জানান এই কথা। তবে এই লড়াইয়ে একা নন মো ফারাহ। বরং, অধিকাংশ সফল ব্যক্তিত্বদের (Successful Personalities) পিছনেই লুকিয়ে রয়েছে কোনো না কোনো ট্রমা (Trauma)। পীড়িত, বেদনাদায়ক শৈশবই লড়াই করার শক্তি জুগিয়েছে তাঁদের। হ্যাঁ, এমনই জানাচ্ছে যুক্তরাজ্যের সাম্প্রতিক গবেষণা।
মনোবিজ্ঞানী ভিক্টর গোয়ের্টজেল, তাঁর ‘ক্রেডলস অফ এমিনেন্স’ গ্রন্থের জন্য বিশ শতকের ৪০০ জন খ্যাতনামা ব্রিটিশ ব্যক্তিত্বদের অধ্যয়ন করেন। সেখান থেকেই উঠে আসে এক ভিন্ন পরিসংখ্যান। তাঁদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই শিকার হয়েছে দারিদ্র, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, গৃহহীনতা, অপব্যবহার কিংবা চরম অসুস্থতার। এই তালিকায় আছে টেরি লেহি, জন লেনন, অ্যাডে অ্যাডেপিটান, অপরা উইনফ্রের মতো ব্যক্তিত্বরা। এমনকি এসব ঘটনা যথেষ্ট ট্রমার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল তাঁদের শৈশবকে। একইভাবে এই তিক্ত অভিজ্ঞতা তাঁদের শক্তি দিয়েছে প্রতিকূলতা-জয়ের।
এছাড়াও ব্রডশিট পত্রিকার একটি একটি ভিন্ন সমীক্ষায়, উঠে আসছে ১৭২১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত, ৫৫ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেই ২৫ জন শৈশবে হারিয়েছেন তাঁদের বাবা-মাকে, ৩ জন হারিয়েছেন ভাই-বোনকে। পাশাপাশি আরও ৮ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী শৈশবে আক্রান্ত হয়েছিলেন ভয়াবহ কোনো শারীরিক কিংবা মানসিক অসুখে।
ভিক্টর গোয়ের্টজেলের এই গবেষণাকে সমর্থন করছেন বোস্টনের টাফ্টস মেডিক্যাল সেন্টারের সাইকিয়াট্রি এবং ফার্মাকোলজির অধ্যাপক নাসির ঘাইমি। জানাচ্ছেন, সাধারণ মানুষ নিরাপদ ও সঙ্গতিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করে। অন্যদিকে সাফল্যের পিছনে কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঝুঁকি নেওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে। বেদনাদায়ক শৈশবই সেই অস্থির শক্তি সরবরাহ করে। তবে শৈশবকালীন ট্রমা বা প্রতিকূলতা নিয়ে রোমান্টিসাইজ করলে ভুল হবে। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দিক তুলে এনেছেন ঘাইমি। ব্রিটেনের এই গবেষণার প্রেক্ষিতে তিনি তুলে এনেছেন ওয়েলসের জাতীয় জনস্বাস্থ্য সংস্থা ‘ওয়েলস পাবলিক হেলথ’-এর রিপোর্ট। যেখানে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, শৈশবে ট্রমার শিকার হলে, মাদকাসক্তি ও অপরাধ জগতে অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা প্রায় ২০ গুণ। ফলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আরও বেশি করে সচেতন হতে হবে সরকারকে, সেই আবেদনই জানাচ্ছেন তিনি। সবমিলিয়ে বলতে গেলে, সফল ব্যক্তিত্বদের পিছনে বেদনাদায়ক শৈশব থাকলেও, ট্রমাই সাফল্যের চাবিকাঠি, এমনটা ভাবলে মস্ত ভুল…
Powered by Froala Editor