“ডাক্তারবাবু বলে গিয়েছিলেন, আমার ছেলে যদি হাঁটতে চায় তাহলে তাকে অল্প অল্প হাঁটতে নিয়ে যেতে। কিন্তু ওরা প্রায় জোর করে টানতে টানতে নিয়ে গেল আমার ছেলেকে। আর যখন ফিরে এল, তখন ছেলে আমার সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। মাথার একদিকে ভয়ঙ্কর আঘাত পেয়েছে।” বলছিলেন মালদার গাজল নিবাসী সিড ঠাকুরের (Sid Tagore) বাবা সঞ্জীবন ঠাকুর। রূপান্তরকামী (Transgender) সিড ঠাকুর মাসখানেক আগে ফ্যালোপ্লাস্টির জন্য ভর্তি হয়েছিলেন কাঁকুড়গাছির শুশ্রূষা নার্সিং হোমে। আর সেখানেই গত পরশু স্বাস্থ্যকর্মীদের হাতে শারীরিক নিগ্রহের (Physical Harassment) শিকার হতে হয় তাঁকে।
এই ঘটনার পর মানসিকভাবে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েন সিড। চিকিৎসকের সামনেই সেরিব্রাল স্ট্রোক হয় তাঁর। এরপর ২৪ ঘণ্টা কথা বলতেও পারেননি তিনি। অথচ বিষয়টি নিয়ে নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ কোনোরকম ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, কোনো পদক্ষেপই নেয়নি বলে জানালেন সঞ্জীবন ঠাকুর। প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা সিডের। সেখানে নিজেকে রূপান্তরকামী বলে পরিচয় দেওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু পরিবারের সহায়তা পেয়েই নিজেকে প্রকাশ করতে পেরেছেন তিনি। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও এটা এক আশ্চর্য ঘটনা বললেও কম বলা হবে।
সঞ্জীবন জানালেন, ছোটো থেকেই নানারকম মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় সিডকে। তাকে প্রথমে একটি গার্লস স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে সহপাঠীরাও নানারকম খারাপ ব্যবহার করত। আর সেই ছোটো বয়স থেকেই সিড বায়না করতেন, তিনি ছেলে হয়ে উঠতে চান। তখন সমস্ত বিষয় এত ভালো করে জানতেন না সঞ্জীবন। তবে সিডের ইচ্ছায় কখনও বাধা দিতে চাননি। প্রহরকে তিনি বললেন, “সন্তানের পাশে থাকাটাই তো আমাদের কর্তব্য।” ২০১৯ সালে প্রথম শরীরের উর্ধ্বাঙ্গের সার্জিক্যাল অপারেশন হয় সিডের। তখন তাঁর বয়স ২৩ বছর। এরপর গত ১৭ আগস্ট কাঁকুড়গাছির শুশ্রূষা নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। তিনবার তাঁর লিঙ্গ সংস্থাপন ব্যর্থ হয়। অবশেষে সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে অপারেশন সফল হয়। এর মাঝেও একাধিকবার স্বাস্থ্যকর্মীদের থেকে অপমানজনক ব্যবহার সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। এমনকি তাঁর ক্ষতস্থানে ইচ্ছা করে বালিশ ছুঁড়ে মারা হয়, যার ফলে ক্ষতস্থান বিষিয়ে ওঠে বলেও জানালেন সঞ্জীবন।
তবে ১৯ আগস্টের ঘটনা সমস্ত নৃশংসতাকে ছাপিয়ে যায়। সিডের কাছ থেকে শোনা সেই বর্ণনা জানালেন সঞ্জীবন। প্রথমে তাঁকে হাসপাতালের সংলগ্ন মন্দির চত্ত্বরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রণাম করতে বলার নাম করে মেঝেতে মাথা ঠুকে দেওয়া হয় একাধিকবার। এরপর তাঁকে লিফটে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং লিফটের মধ্যেই প্রহার করা হয়। যেহেতু লিফটে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না, তাই কোনোকিছুই ক্যামেরায় ধরা পড়েনি। কিন্তু সিডের শরীরের আঘাতগুলির থেকে বড়ো প্রমাণ আর কী হতে পারে? অবশ্য সঞ্জীবন জানালেন, চিকিৎসকরা সবরকমভাবে সাহায্য করছেন। কিন্তু নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের থেকে এমন প্রতিক্রিয়ায় তিনি রীতিমতো ব্যথিত। এই একুশ শতকে এসেও রূপান্তরকামী মানুষদের সবসময় অপমান আর লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়। মানসিক আঘাতের সঙ্গে লড়াই করতে করতে মানিয়ে নেন অনেকেই। যখন সেটা শারীরিক নিগ্রহের জায়গায় পৌঁছায়, তখন তো আর কিছুই করার থাকে না। অন্তত স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে জড়িত মানুষরাও কি একটু সহানুভূতিশীল হতে পারেন না?
আরও পড়ুন
অলিম্পিকের প্রথম রূপান্তরকামী অ্যাথলিট, ইতিহাস গড়ার পথে লরেল হুবার্ড
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
রূপান্তরকামীদের কাজ দিলে আয়করে ছাড়, ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বাংলাদেশের