১৯৯১ সাল। সবমিলিয়ে ১৫টি দেশে ভাগ হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই ঘটনার সূত্র ধরে বিশ্বজুড়ে বদলে গিয়েছিল রাজনৈতিক সমীকরণ। কমিউনিজমের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে এসে পুঁজিবাদের পথে হাঁটা শুরু করে অসংখ্য দেশ। বর্তমানে চিন, কিউবা, ভিয়েতনাম, লাওস ও রাশিয়া— বিশ্বের এই হাতে গোনা কয়েকটি দেশেই শুধুমাত্র জ্বলে রয়েছে কমিউনিস্ট সরকারের বাতি। তবে এসব দেশের জাতীয় পতাকায় দেখা যায় না কমিউনিজমের অন্যতম প্রতীক কাস্তে-হাতুড়িকে। অবশ্য এই তালিকার বাইরে এমন একটি দেশ রয়েছে, যা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘রাষ্ট্র’-এর স্বীকৃতি না-পেলেও, এই প্রতীককে জায়গা করে দিয়েছে নিজেদের জাতীয় পতাকায়।
ট্রান্সনিস্ট্রিয়া (Transnistria)। ইউরোপীয় এই ছোট্ট দেশটির আয়তন মাত্র ৪,১৬৩ বর্গ কিলোমিটার। অর্থাৎ, আকারে ভারতীয় রাজ্য সিকিমের প্রায় অর্ধেক এই দেশ। সবমিলিয়ে সেখানে বসবাস সাড়ে তিন লাখ মানুষের। সচরাচর সংবাদমাধ্যমে ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার নাম দেখা না-গেলেও পূর্ব ইউরোপের এই ছোট্ট দেশটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক রক্তক্ষয়ী ইতিহাস।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে মল্ডোভা। তবে ঠিক যেভাবে যুগোস্লাভিয়ার পতনে সার্ব, স্লাভিক, ক্রোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হয়েছিল ক্ষমতা বিস্তারের দ্বন্দ্ব, সেভাবেই মল্ডোভাও ভাগ হয়ে যায় দুই মেরুতে। মল্ডোভায় (Moldova) অবস্থিত নিয়েস্টার নদীর দক্ষিণ-পশ্চিমে বসবাস ছিল রোমানিয়ান ভাষাভাষীর মানুষরা, অন্যদিকে উত্তর-পূর্বে বসতি ছিল রুশিদের। ফলে দেশ স্বাধীনের কিছুদিনের মধ্যেই দ্বন্দ্ব শুরু হয় দুই নৃগোষ্ঠীর মধ্যে। স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবি করেন রুশ ভাষাভাষীর মানুষরা। অল্পসময়ের মধ্যেই এই দ্বন্দ্ব চেহারা নেয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের।
দীর্ঘ চার মাস ধরে চলেছিল সেই যুদ্ধ। নিহত হয়েছিলেন প্রায় ৭০০ মানুষ। শেষ পর্যন্ত স্বাক্ষরিত হয় যুদ্ধবিরতির চুক্তি। এই বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না বলেই ঘোষণা করে মল্ডোভা। অবশ্য তার কারণও ছিল ভিন্ন। প্রথমত এই অঞ্চল অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না মল্ডোভার কাছে। পাশাপাশি ইউক্রেনের সীমান্তে অবস্থিত এই অঞ্চলকে অনেকটা ‘বাফার জোন’ হিসাবেই ব্যবহৃত করার পরিকল্পনা করে মল্ডোভান সরকার।
এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরই স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ট্রান্সনিস্ট্রিয়া। বর্তমানে নিজস্ব সরকার, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, ডাক ব্যবস্থা, মুদ্রা, সংবিধান, জাতীয় পতাকা রয়েছে এই দেশের। এমনকি বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসাবে জাতীয় পতাকায় কমিউনিজমের প্রতীকচিহ্ন কাস্তে-হাতুড়ির ব্যবহার করে ট্রান্সনিস্ট্রিয়া। তবে এতকিছুর পরেও আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়নি এই দেশটি। তার অন্যতম কারণ হয়তো রাশিয়ান প্রভাব।
১৯৯১ সাল পর্যন্ত সোভিয়েতের সঙ্গে যেমন ঠান্ডা যুদ্ধ চলেছে পশ্চিমী দুনিয়ার, তেমনই সোভিয়েত পরবর্তী যুগে রাশিয়াকে কোণঠাসা করার লড়াইয়ে নামে পশ্চিমী বিশ্বের সংগঠন ‘নেটো’। জন্মলগ্ন থেকেই ট্রান্সনিস্ট্রিয়াকে অস্ত্র, বাড়তি সেনাবাহিনী দিয়ে সাহয্য করেছিল রাশিয়া। দিয়েছিল আর্থিক ও রাজনৈতিক সহায়তা। এমনকি আজও ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার বার্ষিক বাজেটের প্রায় অর্ধেক ভর্তুকিই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রদান করে রাশিয়া। সে-দেশে চলে রাশিয়ান টেলিভিশন চ্যানেল। স্কুলে পড়ানো হয় রাশিয়ার পাঠ্যপুস্তক। আর সেই কারণেই একপ্রকার ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে ইউরোপ ও আমেরিকা। রাষ্ট্রপুঞ্জে বার বার এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এই দেশের প্রসঙ্গ।
অবশ্য স্বতন্ত্র দেশ হিসাবে টিকে থাকলেও ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠছে এই দেশের ভবিষ্যৎও। ক্রমশ বেড়ে চলেছে চাকরির অভাব। কাজ খুঁজতে সে-দেশের অধিকাংশ তরুণ-তরুণী রাশিয়া বা মস্কোয় পাড়ি দেওয়ায় কমে চলেছে জনসংখ্যাও। অন্যদিকে ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার প্রবীণরা মনে-প্রাণে চান রাশিয়ার সঙ্গে পুনরায় সংযোজিত হতে। যদিও ভৌগোলিক কারণে এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো আগ্রহই দেখাননি রাশিয়ার সর্বেসর্বা ভ্লাদিমির পুতিন।
Powered by Froala Editor