লুইস গ্লুক এর কবিতা
অনুবাদঃ অনিমিখ পাত্র
মাত্র আঠেরো বছর বয়সে কবিতায় হাত খড়ি। ২৫ বছর বয়সে প্রথম কবিতার বই ‘ফার্স্টবর্ন’। লুইস গ্লুক। তাঁর প্রথম সন্তান, প্রথম কাব্যগ্রন্থই সাড়া ফেলে দিয়েছিল সাহিত্যের জগতে। তারপর আস্তে আস্তে বেড়েছে পরিধি। মেলভিন কানে, পুলিৎজার পুরস্কার জুটেছে আগেই। এবার তাঁর মুকুটে জুড়ল নোবেলের পালক। যে কবিতা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছিল মৃত্যুর থেকে, সেই কবিতায় এবার তাঁকে পাইয়ে দিল শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান। আমেরিকার সেই আশ্চর্য কবিরই কিছু কবিতারই অনুবাদ রইল, অনিমিখ পাত্রের কলমে...
১। নকটার্ন
মা মারা গেছে গত রাতে,
মা যে কখনও মরে না।
শীতকাল ছিল বাতাসে
এখনও অনেক দূর
কিন্তু তবুও শীতকাল ছিল বাতাসে।
মে মাসের দশ তারিখ ছিল
হায়াসিন্থ আর আপেল ফুল
ফুটেছিল পেছনের বাগানে।
আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম
মারিয়া গান গাইছে চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে –
আমি কত একা –
এই ধরণের গান।
আমি কত একা
মা নেই, বাবা নেই –
আমার মাথা যেন কী ফাঁকা তাদের ছাড়া
সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে মাটি থেকে;
থলাবাসনগুলো সিঙ্কে,
ধোওয়া কিন্তু এখনও গুছিয়ে রাখা হয়নি।
পূর্ণ চাঁদের নিচে
মারিয়া কাচা জামাকাপড় ভাঁজ করছিল
শক্ত কাপড়গুলো হয়ে গেল
শুকনো সাদা জ্যোৎস্নার আয়তক্ষেত্র।
আমি কী একা, কিন্তু সঙ্গীতে
আমার একাকীত্বই আমার আনন্দ।
সেটা ছিল মে মাসের দশ তারিখ
ঠিক যেমনটা ছিল ন’তারিখ, আট তারিখ।
মা তার বিছানায় ঘুমোচ্ছিল
তার হাতগুলো ছড়ানো, তার মাথা
তার মাঝখানে ভারসাম্যে রাখা।
২। মা ও শিশু
আমরা সবাই স্বপ্নদ্রষ্টা, আমরা জানি না আমরা কারা
কোনো মেশিন আমাদের তৈরি করেছিল, এই দুনিয়ার মেশিন, বেঁধে রাখা পরিবার।
নরম চাবুকে ঘষামাজা হয়ে, তারপর দুনিয়ায় ফেরৎ যাওয়া।
আমরা স্বপ্ন দেখি; আমরা মনে রাখি না।
পরিবারের মেশিনঃ অন্ধকার লোমশ ফার, মাতৃদেহের অরণ্য
মায়ের মেশিনঃ মায়ের ভেতরে সাদা শহর।
এবং তার আগেঃ মাটি আর জল।
পাথরের মাঝে মস, পাতা আর ঘাসের টুকরো।
আরও আগেঃ বিরাট অন্ধকারের মধ্যে কোষগুচ্ছ
এবং তারও আগেঃ পর্দাঢাকা পৃথিবী।
এই কারণেই তোমার জন্মঃ আমাকে চুপ করিয়ে দেবার জন্য।
আমার মায়ের আর বাবার কোষ, এখন তোমার পালা
মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠার, মাস্টারপিস হয়ে ওঠার।
আমি সহসা উদ্ভূত, আমি কক্ষনও মনে রাখিনি।
এখন তোমার চালিত হওয়ার পালা;
তুমিই সে যার জানবার দাবি আছে
আমি কেন কষ্ট পাই? আমি কেন কিছু জানি না?
বিরাট অন্ধকারে স্থিত কোষগুচ্ছ। কোনো মেশিন আমাদের তৈরি করেছিল।
এবার তোমার ডাক দেবার পালা, জিজ্ঞেস করার পালা
কীসের জন্য আমি? কীসের জন্য আমি?
৩। শীতের শেষ
স্থির এই পৃথিবীতে, কালো বৃক্ষশাখার মধ্যে
একা জেগে উঠে ডাকে পাখি।
জন্ম নিতে চেয়েছিলে তুমি, আমি তোমাকে জন্ম নিতে দেব।
তোমার খুশির পথে কখনই বা
আমার শোক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলো?
একইসঙ্গে ডুবে গিয়ে অন্ধকার আর আলোয়
সংবেদনের জন্য উন্মুখ
যেন তুমি নতুন একটা জিনিস, নিজেকে
প্রকাশ করতে চাইছ
সব চমৎকারিত্ব, সব প্রাণবন্ততা
কখনও ভাবোনি
যে তোমাকে কিছু মূল্য চোকাতে হতে পারে,
তুমি কখনও কল্পনা করোনি আমার কন্ঠস্বর
তোমার অংশ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে –
অপর জগতে তুমি তাকে শুনতে পাবে না
আর কক্ষনও পরিষ্কারভাবে পাবে না,
কোনো পাখির ডাকে বা মানুষের কান্নায়।
কোনো পরিষ্কার আওয়াজ নয়, কেবল
সমস্ত শব্দের
নাছোড় প্রতিধ্বনি
যার মানে বিদায়, বিদায় –
এক অবিচ্ছিন্ন রেখা
যা আমাদেরকে একে অপরের সঙ্গে বেঁধে রাখে।
৪। ডুবে যাওয়া বাচ্চারা
দ্যাখো, ওদের কোনো বিচারবুদ্ধি ছিলো না।
সুতরাং ওরা যে ডুবে যাবে সেটাই স্বাভাবিক।
প্রথমে, বরফ ওদের টেনে নেয়,
আর তারপর সারা শীতকাল, যতক্ষণ না
ওরা ডুবতে ডুবতে শেষে নীরব হয়ে যায়
ততক্ষণ ওদের পেছনে ওদের উলের স্কার্ফগুলো ভাসতে থাকে
এবং তার বহুবিধ অন্ধকার হাত দিয়ে পুকুর তাদের তুলে নেয়
কিন্তু মৃত্যু নিশ্চয়ই তাদের কাছে ভিন্নভাবে আসে,
শুরুর এত কাছাকাছি।
যেন ওরা সবসময়ই অন্ধ আর ওজনশূন্য ছিল। সুতরাং
বাকিটুকু স্বপ্নে দেখা, আলোকবাতিটি,
টেবিলকে ঢেকে রাখা সুন্দর সাদা চাদর,
ওদের দেহগুলি।
এবং তবুও তারা শোনে তাদের ব্যবহৃত নামগুলি
যেন পুকুরের ওপর ঢলে পড়া টোপঃ
কীসের জন্য অপেক্ষা করছো তোমরা?
বাড়ি এসো, বাড়ি এসো, জলের মধ্যে হারানো,
চিরস্থায়ী আর নীল।
Powered by Froala Editor