জ্বলন্ত মশাল দিয়ে মাছ শিকার! মৃত্যুর পথে তাইওয়ানের প্রাচীন প্রথা

আদিগন্ত সমুদ্রের মাঝে দাউ দাউ করে জ্বলছে অগ্নিশিখা। হঠাৎ দেখলে আলেয়া বলে ঠাহর হওয়াই স্বাভাবিক। তাইওয়ানে রাতে অন্ধকারে সমুদ্রভ্রমণে গেলেই দেখা মিলবে এই অদ্ভুত দৃশ্যের। কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, এই অগ্নিশিখা মানুষেরই তৈরি। আর এই আগুন জ্বালানোর মূল উদ্দেশ্য হল মাছ শিকার। হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও এমনটাই সত্যি। ‘ফায়ার ফিশিং’-খ্যাত (Fire Fishing) এই মৎস্যশিকারের পদ্ধতি শতাব্দীপ্রাচীন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই এবার সম্পূর্ণ অবলুপ্তির পথে তাইওয়ানের (Taiwan) ঐতিহ্যবাহী (Tradition) এই মাছ শিকারের পদ্ধতি।

প্রশ্ন থেকে যায়, মাছ শিকারের সঙ্গে আগুনের এই মশালের সম্পর্ক কী? এই উত্তর খোঁজার আগে বলে রাখা দরকার, মূলত সার্ডিনের শিকারের জন্যই ব্যবহৃত হয় ফায়ার ফিশিং পদ্ধতি। উজ্জ্বল হলুদাভ অগ্নিশিখায় আকৃষ্ট হয় এই বিশেষ প্রজাতির মাছ। সমুদ্রের জলস্তর থেকে লাফিয়ে আলোর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে সার্ডিনের ঝাঁক। ঠিক সেই সময়ই জালবন্দি করা হয় তাদের। এই পদ্ধতিতে শুধুমাত্র সার্ডিন ধরা পড়ায় যেমন বাছাইয়ের ঝঞ্ঝাট থাকে না, তেমনই খুব সহজেই বিপুল পরিমাণের মাছ ধরা পড়ে জালে। 

ট্রলার কিংবা মোটরবোট তখনও কল্পনাতীত। আজ থেকে কয়েক শতক আগে থেকেই ছোট্ট ডিঙি নৌকায় চড়ে এই পদ্ধতিতে মাছ ধরে আসছেন তাইওয়ানের স্থানীয় মৎস্যজীবীরা। তাইওয়ানের বাজারে এই বিশেষ প্রজাতির মাছের চাহিদাও ছিল আকাশছোঁয়া। তবে ক্রমশ সেই বাজার নিম্নমুখী। সেইসঙ্গে ধারাবাহিকভাবেই হ্রাস পেয়েছে মাছের সংখ্যাও। সবমিলিয়ে লাভের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় এই পেশা ছেড়েছেন অধিকাংশ মৎস্যজীবীই। 

ছয় দশক আগেও তাইওয়ানে ১০০-র বেশি ফায়ার ফিশিং বোট মৎস্য শিকারে যেত গভীর সমুদ্রে। আজ সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কেবলমাত্র ১টিতে। আর তার নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় মৎস্যজীবী সু চেং-চেং। কেবলমাত্র ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতেই আজও নিয়ম মেনেই রাতের বেলায় সমুদ্রে পাড়ি জমান চেং-চেং।

আরও পড়ুন
ভারতের একমাত্র হাতে তৈরি শাটল কক উলুবেড়িয়ায়, ধুঁকছে ঐতিহ্যবাহী সেই শিল্পও

২০১৫ সালে ফায়ার ফিশিং-কে ‘কালচারাল অ্যাসেট’ হিসাবে ঘোষণা করে তাইওয়ান সরকার। তবে চেং-চেং এর বিশ্বাস, অর্থ বিনিয়োগে কোনোভাবেই সংরক্ষণ করা সম্ভব নয় এই ঐতিহ্যকে। কারণ, মূল প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে সার্ডিনের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া। আর সেই কারণে, নিজেই অভিনব এক পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। জালে ধরা পড়া অধিকাংশ সার্ডিনকেই তিনি ছেড়ে দেন সমুদ্রে। বিশ্বাস, একমাত্র নিয়ন্ত্রিত মৎস্য শিকারই ফের সার্ডিনের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে। আর উপার্জন? তার জন্যও অভিনব পন্থা নিয়েছেন চেং-চেং। এক কথায় ঐতিহ্যবাহী এই মৎস্য শিকার দেখতেই তাইওয়ানে হাজির হন হাজার হাজার পর্যটক। অর্থের বিনিময়ে তাঁদেরকে এই অভিযানের সঙ্গী করেন চেং-চেং এবং তাঁর সহকারীরা। তাতে আর্থিক লাভ যে খুব কম হয়, তেমনটা নয়। পাশাপাশি ঐতিহ্যকে তাঁর এই উদ্যোগ তাইওয়ানের শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যকে পৌঁছে দিচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছেও। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে পরবর্তী প্রজন্মও। তবে তাঁর দেখানো পথে সরকারও একদিন হাঁটবে, সে ব্যাপারে ক্ষীণ আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন চেং-চেং…

আরও পড়ুন
ঐতিহ্যবাহী টেস্ট পেপার, অবিভক্ত বাংলার শিক্ষক-ঐক্য ও শতবর্ষের এবিটিএ

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যের ইতি, বন্ধ হতে চলেছে রেলের মুদ্রিত টাইমটেবিল