পাইন্ড আইল্যান্ড এবং থোয়েটাস, এই দুই হিমবাহ আন্টার্কটিকার অন্যতম দুটি বড়ো হিমবাহ। তবে দুটি হিমবাহই গলছে অত্যাধিক দ্রুত হারে। সাম্প্রতিক স্যাটালাইটের ছবি এমনই ভয়ঙ্কর তথ্য তুলে ধরল বিজ্ঞানীদের সামনে। যা রীতিমতো ঘুম কেড়ে নিয়েছে তাঁদের। বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে মুছে যেতে চলেছে আন্টার্কটিকার এই দুই হিমবাহ। ইদানীং পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যতটা বেড়েছে, তার ৫ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য দায়ী কেবলমাত্র এই দুটি বরফের ছাদ।
গত সোমবার ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এই গবেষণাপত্র। নেদারল্যান্ডসের ডেলফ্ট ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির স্যাটেলাইট বিশেষজ্ঞ স্টিফ লের্মিটের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী এই গবেষণা চালান। ১৯৯৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দুই হিমবাহের স্যাটালাইট চিত্রের সাহায্যের তাঁরা নির্ণয় করেন বরফ গলনের হার।
তাঁদের এই গবেষণাতেই উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জলের মধ্যে ভেষে থাকা হিমবাহগুলির ভিত্তিই দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। বিগত কয়েক দশক ধরেই গতিবৃদ্ধি পেয়েছে এই ক্ষতির। তবে তা আশঙ্কাজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে মূলত ২০১৬ সালের পরেই। হার বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় পাঁচগুণ। এবং বরফ গলনের এই গতি যে খুব শীঘ্রই ধসিয়ে ফেলতে পারে পুরো হিমবাহকে, রয়েছে সেই সম্ভাবনাও। ইতিমধ্যেই এই অন্যতম বৃহৎ বরফখণ্ড দুটির গায়ে স্পষ্ট হয়ে এসেছে ফাটলের দাগ। ক্ষয়ে গেছে দেয়ালের অনেক অংশই। এই ক্ষতচিহ্নগুলিই বরফের গলনকে ত্বরান্বিত করছে আরও। অন্যদিকে বরফের গলন যেমন বেড়েছে তেমনই কমেছে এই অঞ্চলে তুষারপাত। ফলে ক্ষতস্থান কখনই সারিয়ে উঠতে পারছে না হিমবাহ দুটি।
বাইরে থেকে এইটুকুই নজরে আসছে হিমবাহ দুটিকে দেখে। তবে এর গোপনেই চলছে আরও বড়ো ধ্বংসলীলা। এই দুটি হিমবাহ পারতপক্ষে আন্টার্কটিকার সঙ্গে জুড়ে রেখেছে সমুদ্রকে। আর চোখের আড়ালেই সেখানে আরও গভীর হচ্ছে ক্ষত। দৃশ্যমান অংশের তুলনায় যার আয়তন প্রায় ৯ গুন। সমুদ্রের সঙ্গে হিমবাহের সংযোগ সেই অংশেই। সমুদ্রস্রোতের বহমানতা এবং উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জলে নিচে লুকিয়ে থাকা সেই অংশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবথেকে বেশি। ফলে নিচ থেকেই দুর্বল হয়ে পড়ছে হিমবাহ দুটি। যার ফল স্বরূপ কিছুদিনের মধ্যে বরফের সাজানো তাকগুলি আলাদা হয়ে পড়বে ধীরে ধীরে। ভাসমান বরফের টুকরোগুলির ক্ষয় বেড়ে যাবে আরও কয়েকগুণ।
আরও পড়ুন
বরফ নয়, আন্টার্কটিকা জুড়ে ছিল রেইন ফরেস্ট – অতীতের হদিশ দিলেন বিজ্ঞানীরা
আয়তনের দিক থেকে দেখতে গেলে থোয়েটাস ১ লক্ষ ৯২ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে রয়েছে। যা প্রায় গ্রেট ব্রিটেনের সমআয়তন। পাইন আইল্যান্ডের আয়তন এর প্রায় ৯০ শতাংশ। শুধুমাত্র থায়োটাস ধসে পড়লেই পৃথিবীর জলস্তর বৃদ্ধি পায়ে ২ ফুট ১ ইঞ্চির মতো। তার সঙ্গে পাইন আইল্যান্ডের গলন যুক্ত হলে সেই উচ্চতা বেড়ে দাঁড়াবে ৪ ফুটে। এবং তা আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ঘটতে চলেছে বলে বিজ্ঞানীদের অনুমান।
আন্টার্কটিকা ছাড়াও গ্রিনল্যান্ডের বৃহত্তম হিমবাহের অস্বাভাবিক গলনও চোখে পড়েছিল কিছুদিন আগেই। যা প্রতিবছর পৃথিবির জলস্তরকে বাড়িয়ে দিচ্ছে ১ মিলিমিটার করে। এশিয়া এবং অন্যান্য মহাদেশগুলির হিমবাহেরও গলন হচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে। যার মিলিত ফলস্বরূপ মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়বে। বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়বে পৃথিবীর অধিকাংশ সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলই।
আরও পড়ুন
আন্টার্কটিকার বরফশীতল জলে সাঁতার, উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সাঁতারুর
এই দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকা বিপদকে একমাত্র প্রশমিত করতে পারে আবহাওয়া পরিবর্তনে মানুষের হস্তক্ষেপ। কার্বন নির্গমনকে কমিয়ে আনলে তবেই কেবলমাত্র প্রকৃতির থেকে কিনে নেওয়া যেতে পারে কিছু বাড়তি সময়, এমনটাই জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তবে সত্যিই কি তৎপর প্রত্যেকটা রাষ্ট্রের প্রশাসন? প্রত্যেক দেশের সম্মিলিত প্রচেষ্টার অভাব থাকলে কোনোদিনই মোকাবিলা করে ওঠা সম্ভব হবে না এই পরিস্থিতির। আন্টার্কটিকার গলন আটকাতে গেলে যতটা ভূমিকা দরকার অস্ট্রেলিয়ার। ততটাই দরকার আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইতালি, চিন, ভারতের মতো উত্তরের দেশগুলিরও। কিন্তু এত সতর্কবার্তার পরেও সচেতন হচ্ছে না দেশের ‘ক্ষমতাশালী’ প্রধানেরা...
Powered by Froala Editor