সারাদিন করে না কিচ্ছুটি, রাত্তিরেই অন্য মানুষ হয়ে যায় সে

অবিনাশের কোথাও তেমন যাওয়ার নাই, যাওয়ার মত গোটা দুই জায়গা ছিল অবশ্য, কিন্তু গত তিনবছর আগেই সেসবের পাঠ চুকে গেছে, প্রথম জায়গাটা হল শ্যালক তিনকড়ির বাড়ি, বছর তিনেক আগেও সেখানে দিব্যি যেত অবিনাশ, বেশ একটা মনের মিল ছিল দুজনের, গল্পগুজব করত, অনেক রাত্রে দুজনেই বোতল খুলত, এটা সেটা আলোচনা তর্ক করত, বেশ চলছিল, অবিনাশের একঘেয়ে লাগলেই শালার বাড়িতে এসে দুদিন কাটিয়ে যেত, একদিন মালের ঘোরেই কী একটা নিয়ে তুমুল তর্ক, অমনি শ্যালক তিন কড়ি তর্কে এঁটে উঠতে না পেরে শুনিয়ে দিলে ‘শালা বসে বসে খেলে অমনি মনে হয়’, ঘটনাচক্রে অবিনাশ কিছুই করে না, করার প্রয়োজনও বোধ করে না, সামান্য দুবিঘে জমিতে লোক লাগিয়ে চাষ করায়, তাতেই চলে গোটা বছরের খোরাকি, বৌ পঞ্চায়েতে একটা কাজ করে, ব্যাস এইটুকুই তার আয়, শ্যালকের কথায় সেদিনের পর আর তার মুখ দেখেনি অবিনাশ...

আরেকটা জায়গায় তার যাতায়াত ছিল, সেটা হল এই গ্রামের একদম শেষে বৃদ্ধ গঙ্গাধরের বাড়ি, কৈশোরে একদিন ঘুরতে ঘুরতে গঙ্গাধরের বাগানে ঢুকে পড়েছিল অবিনাশ, ঢুকেই দেখে চারিদিকে শুধু ফুল আর ফুল, একটু দূরে একটা লোক একটা দোতারা নিয়ে টুং টাং করছে, এই তারটা বাঁধছে তো ওই তারটায় হাল্কা ঢিল দিচ্ছে, কিশোর অবিনাশকে দেখে সেই যে গঙ্গাধর গোটা দুই গান শোনালে, ওখানেই অবিনাশের পৃথিবী থমকে গিয়েছিল, গান শুনে তার বুকের ভিতর কেমন একটা হয়েছিল, মনে হয়েছিল গঙ্গাধর কোনও দেবতা, যে বুকের মাঝে মায়া তৈরি করতে জানে, তারপর বহুদিন অবিনাশ গঙ্গাধরের কাছে গেছে, গান শুনেছে, একলা লোকটাকে বাড়ি থেকে রান্না করে এনে খাইয়েছে, গল্প করেছে প্রচুর, কথা বলতে বলতে অবিনাশ বুঝতে পেরেছে এ-জীবনে কিছু করার মানে আসলে গঙ্গাধরের কাছে আলাদা, ক্রমে ক্রমে সেই ধারণা তার মগজেও জাঁকিয়ে বসেছে, অবিনাশের ইহজাগতিক কিছুই আর করা হয়ে ওঠেনি, বউ নেহাতই গরিব বাড়ির গোছানো মেয়ে, তাই নিজের মত করে গড়ে পিটে  নিয়েছে সংসারকে, নইলে অবিনাশের কবে আর সংসারে মন ছিল? অবিনাশ কী খোঁজে কেন খোঁজে গ্রামের কেউ জানে না, এমনকি তার নিজের বউ ছেলেও জানে না, তারা শুধু দেখে বছর তিনেক আগে গঙ্গাধর মরে যাওয়ার পর ওদিকে আর যায় না অবিনাশ, আজকাল নদীর পাড়ে হেলানো বট গাছটার নীচের ভাঙা মাচায় সারাদিন বসে থাকে, দুপুরে জলে নেমে চান করে, বাড়ি থেকে ছেলে খাবার দিয়ে যায় ওখানেই, ওখানেই বসে খায়, হাত মুখ ধোয়, তারপর শুয়ে শুয়ে কী যেন ভাবে, গোটা গ্রামের লোক জানে লোকটা ভালো হলেও, সেরকম কিছু করতে পারেনি বলে মাথাটা পাগলে গেছে, আর সারবে না

অবিনাশের মাথার ভিতরে তখন অদ্ভুত এক বোধ খেলা করে, আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে দুটো চোখ, অনেক রাতে প্যাঁটরা খুলে একটা পুরনো খাতা বের করে অবিনাশ লিখতে বসে, গুনগুন করে গান গায় খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে বিড়ি খেতে খেতে