এ গাঁয়ের শেষে যেখানে বুনো কচুর জঙ্গল শুরু হয়েছে, ঠিক তার ডানপাশ দিয়ে চলে গেছে আল রাস্তা, আল রাস্তা ধরে তিনটে বাঁশ ঝাড় পেরুলেই কঘর লোকের বসতি, ঘর বলতে খড় দিয়ে ছাওয়া ছিটে বেড়ার ঘর, দরজা শক্ত চাঁচের, মুরগি চরে বেড়ায় দোরে দোরে, পিছনে একগাদা ছানাপোনা, ঘরের সামনের উঠোনে তিন চারটে বাচ্চা ছেলে মেয়ে, তালপাতার গাড়ি বানিয়ে খেলছে, দুজন বসেছে আর একজন প্রাণপণে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, সবচে ছোট্টটি পাশের বকুল গাছের নীচে বসে বসে মাটি খাচ্ছে, লোকে বলে ওর পেটে কৃমি হয়েছে, তাই কোমরে ঝুলছে ঘুনসি আর সাদা কড়ি,
এই কঘরে ওদের বাপ কাকা দাদারা থাকে, ওরা দেখে সকাল বেলায় ল্যাঙট এঁটে হাতে বাঁশের লাঠি আর জাল কাঁধে করে ওদের বাপ কাকারা বেড়িয়ে যাচ্ছে, এইভাবেই দিনের পর দিন পার, দুপুরের পর যখন ওদের বাপ কাকারা ফেরে তখন ওরা ঘুমিয়ে কাদা
মহিম, বিনয়, শুকুর, পঞ্চারা বিলে মাছ ধরে, নির্দিষ্ট কোনো বিল নাই, এই বিল সেই বিল করে বেড়ায়, বিলের মালিকের কাছে গিয়ে গিয়ে হত্যে দেয়, বলে একবার লামতে দিন না কত্তা, এই দুহাত সাইজের একটা সেদিন দেকেচি, ঘাই মাচ্ছিল, ঐটের সবটা আপনার, লামি কত্তা একবার, এইভাবে মালিকদের ওরা পটায়, মাছের লোভ দেখায়, তারপর অনুমতি মিললে হইহই করে নেমে পড়ে জলে, বিল বড় হলে আর অনেক জংলা থাকলে ঘর থেকে কাঁধে করে সাতজনে বয়ে নিয়ে যায় ছোট ডিঙি নৌকাটা, সেইটায় গুটিসুটি মেরে উঠে বসে ওরা, দুজন পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে হাঁড়ি নিয়ে
ডিঙি মাঝ বিলে গেলে ওরা শূন্যে হাত ঘুরিয়ে জাল ছোঁড়ে জলে, আস্তে আস্তে নৌকা চালায়, জাল আটকে যায় জংলায়, তখন একে একে জলে নামে, একবুক জলে দাঁড়িয়ে জাল থেকে কাঁটা ছাড়ায়, ফের জাল ছোঁড়ে, পাড় থেকে জুলজুল করে বাকিরা চেয়ে থাকে, মহিম ভাবে আজ কপালে কী লেখা আছে কে জানে! খালি হাতে ফিরতে হলে আর দেখতে হবে না, কচি মেয়েটা জ্বরে মরবেই, জাল ভরে এলে আনন্দ হয়, মাছেরা যেভাবে ছটফট করে ওঠে ওর ভিতরটা ঠিক সেভাবেই খিদিবিদি করে ওঠে, একটু একটু করে পয়সা জমাচ্ছে, এইবার পুজোর আগে ঘরের চালটা ছাইতে হবে, পুরনো খড় একদম ফেঁসে গেছে, বাতাসে ঝরে পড়ে, বৌকে একটা ভালো প্রিন্টের শাড়িও দিতে হবে, মহিমের বিয়ের কথা মনে পড়ে, বিয়ের পর লোকের ঘরে এটা সেটা কাজ করে মেয়েটা পুরোনো শাড়ি চেয়েচিন্তে পরে সারাবছর, সে আর কবে কিনে দেবে!
হঠাৎ জালে টান লাগলে তার চটকা ভাঙে, তখন সবাই হুটোপুটি করে জাল টানে, শুকুর চেঁচিয়ে ওঠে ভালো করে ধর রে বাঁড়া ঐদিকটা, ঐধার বাগে পালালে ফের কসরৎ করতে হবে
মাছ ধরা শেষ হলে মালিককে পাওনা গণ্ডা মিটিয়ে ওরা নিজের মাছ ভাগ করে নেয়, ঘরে গিয়ে বউদের দেয়, বউয়েরা একটা ঝুড়িতে মাছ নিয়ে এ গাঁ সে গাঁ মাচ লেবে গো মাচ বলে হেঁকে বেড়ায়, আজকাল গাঁয়ে মাছ বিক্রি ভালো না বলে ওরা শগ্রাই মোড় পেরিয়ে বড় রাস্তা ধরে আধা শহরে আসে
নিজেরা কখনও মাছ খায় না, খেতে পায় না, মাছ ধরতে গিয়ে খালুই ভর্তি করে গুগলি পায়, ওদের বউরা ঝাল ঝাল করে গুগলি রাঁধে, মেটের মত খেতে বলে সাপটে খেয়ে নেয়, ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলো এ ওর পাত থেকে এটা ওটা তুলে নেয়, কাঁদে, ভাত মাখে মুখময়, নাক দিয়ে শিকনি নাল ঝোল গড়ায়
শুকুর খেতে খেতে ভাবে আজ বাবুর ঘরে যে কাতলটা গেছে, একদিন ওইরকম একটা কাতল সে আনবে এই বর্ষায়...