মনসুর কুলগড়ের জঙ্গলে যায়, শরীরটা আলামারা না লাগলে প্রায়ই সে সকাল-সকাল বেরিয়ে যায় চাট্টি বাসিভাত খেয়ে, বাসিভাত খেতে তার খুব ভালো লাগে, আগের রাতে বউ জাফরিনা বেঁচে যাওয়া ভাতগুলো পানিতে ভিজিয়ে দেয়, পরদিন মনসুর খাবে বলে
আসলে এই অভ্যাস মনসুরের ছিল না, সকালে উঠেই সে জঙ্গলে যাবার পথে আনসারের দোকানে কখনও কার্গিল বিস্কুট কখনও লেড়ো কিম্বা পাউরুটি চায়ে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খেয়ে, তারপর হড়হড় করে খানিকটা পানি খেয়ে কুলগড়ে যেত, একদিন রাতে দুজনে খেতে বসে জাফরিনা দেখে ভাত বেঁচে গেছে, মনসুর ঠেলে ঠেলে ভাত খেয়েও শেষ করতে পারলে না, জাফরিনা বললে ‘আহা নষ্ট করবো! মা সাদাহান’
আরও পড়ুন
'এই পাটুলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আমার কথাই বলছেন লালন' - সাত্যকি ব্যানার্জির সাক্ষাৎকার
সাদাহান আসলে কী ভাষা জাফরিনা জানে না, সে দেখেছে মা চাচী এমনকি এই গফফারপুরের সকলেই বলে, ধান চাল এসবকে ওই নামেই ডাকে, নষ্ট করলে গুনাহ হয়, জাফরিনা বেঁচে যাওয়া ভাতে পানি ঢেলে ভিজতে দিলে, পরদিন মনসুর ওই ভাত পেঁয়াজ লঙ্কা আর একটু সর্ষের তেল দিয়ে সাপটে খেয়ে নিলে, খেতে তার দারুণ লেগেছিল, সারাদিন তেমন খিদে খিদে পায়নি, শরীরটা ঠান্ডা-ঠান্ডা লাগছিল, সেই থেকে বাসিভাত খেয়েই কুলগড়ের জঙ্গলে সে কাঠ ভাঙতে যায়
মনসুর এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়, প্রথমে দেখে কোনো ডাল ভেঙে পড়ে আছে কিনা, গোটা জঙ্গলটা একবার চক্কর দেয়, তারপর পড়ে থাকা ডালগুলোকে কুড়ুলে করে চেলিয়ে ছোট করে মাথায় তুলতে তুলতে যায়, যেদিন দেখে কোনো ডাল ভেঙে পড়ে নেই সেদিন তার পরিশ্রম দ্বিগুণ, সে বোঝে আজ কপালে দুঃখ আছে, কাঁচা ডাল কাটতে হবে, শুকোতে হবে, খুব হ্যাপা
কুলগড়ের জঙ্গলটা আসলে কারো নয়, মনসুর ছোটবেলায় শুনেছে এটা সামন্তদের, তারা এখন সব মরে হেজে গেছে, ফলে গাছ কাটলে ডাল ভাঙলে কেউ কিছু বলে না, মনসুর মাথায় করে সেইসব ডাল বয়ে ঘরে আনে, জাফরিনা সেগুলো এগনে অর্থাৎ উঠোনে শুকোতে দেয়, জাফরিনা জানে যত শুকোবে তত ভালো জালন, বুধবারের হাটে জাফরিনা জালন নিয়ে যায়, সারাদিন জালন বেচে, তার সব জালন উঠে যায়, খুশি হয়ে পয়সাগুলো সাবধানে ঘরে আনে, মনসুর আর জাফরিনা গুনতে বসে, গুনতে গুনতে ভুল হলে মনসুর বলে ‘তুই এই বিদ্যে লিয়ে জালন বেচিস?’ মনসুর খুক খুক করে হাসে, একটা ভারিক্কি ভাব নেয়, মনসুর ফোরের পর ইস্কুল যায়নি, জাফরিনা ইস্কুলই যায়নি
মনসুর বনের ভিতর কাঠ ভাঙতে গিয়ে একদিন দেখে একটা গাছের নিচে একটা ভাঙা বেদি, এত ভেঙে গেছে যে ওটাকে আর বেদি বলে চেনা যায় না, মনসুর প্রথমে অত পাত্তা দেয়নি, মুসলমানের ছেলে এত কৌতূহল ভালো না, কে জানে কোন দেবতা, কার মনে কী আছে, কোন হওয়া বাতাস লেগে যায় ভেবে কাঠ ভাঙতে চলে গেছিল, সেদিন মনসুর দেখলে গোটা জঙ্গলে অনেক কাঠ এমনিই ভেঙে পড়ে আছে, মনসুর মনে মনে খুব খুশি হল, এত কাঠ সে একদিনে কখনও পায়নি, হঠাৎ তার মনে হল তাহলে কি ওই দালান বেদির দেবতা মুখ তুলে চেয়েছে! তার মনে হল সে তো মুসলমান, হিন্দুর অজানা দেবতা তার জন্য এত কেন করবে? যাইহোক কাঠ তুলে সেদিন ঘরে এল সে
পরদিন সকালে বাসিভাত খেতে খেতে জাফরিনাকে বললে ‘মা সাদাহানকে কখনও নষ্ট করবি না বুইলি?’
সারারাত সে ওই দালানের কথা ভেবেছে, তার মনে হয়েছে তাহলে কি ওই বেদির দেবতাই মা সাদাহান?
তার মন খচখচ করছিল, সারাদিন কাঠ ভেঙে ফেরার সময় বেদির কাছে গেল, ছুঁয়ে দেখলে বেদিতে, তারপর কী মনে করে একটু দূরের ঝাড় থেকে কয়েকটা ঘেঁটুফুল তুলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বেদিতে দিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল, আসতে আসতে ভাবলে পুবপাড়ার নিতাইরা দেবতাকে এইভাবে ফুল দেয়, সেও দিলে
কিন্তু কথাটা সে কাউকে বলবে না, জাফরিনাকেও না
তাদের পাড়ায় কেউ কোনোদিন পুজো করেনি