৮০ বছরের এক বৃদ্ধ বসে রয়েছেন নিজের বাড়িতে। বিকেলবেলায় হঠাৎ এক যুবতী এলেন। এসে দাবি করলেন, সেই বৃদ্ধই তাঁর বাবা। কিন্তু তা কী করে হয়? তাঁর নিজের সন্তানও রয়েছে। কিন্তু যুবতীর হাতে রয়েছে ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট। তাতে স্পষ্ট প্রমাণ হয় সবই। কিন্তু কীভাবে এমন অসম্ভব সম্ভব হল? বৃদ্ধের দান করা শুক্রাণু (Donated Sperm) থেকেই জন্ম হয়েছে যুবতীর। অথচ বৃদ্ধ নিজে তো কোনোদিন শুক্রাণু দান করেননি। তাহলে কি কেউ চুরি করেছে? কিন্তু কারা এই শুক্রাণু অপহরক দল (Sperm Heist)?
কাহিনিটা শুরু হয় বেশ কয়েক বছর আগে। ইংল্যান্ডের এক তরুণীর সদ্য বাবা মারা গিয়েছে। কিন্তু বাবার উইলে বেশ কিছু জটিলতার কারণে মেয়ের সম্পত্তির অধিকার পেতে দেরি হয়ে যায়। এই নিয়ে মেয়ে যখন বাবার উপর রীতিমতো রেগে রয়েছে্ন, তখনই তার মা এসে জানালেন কেন বাবা বাধ্য হয়েছিলেন এমন একটা জটিল উইল তৈরি করতে। কারণ তিনি যদি তাঁর ছেলেমেয়েদের সব সম্পত্তি দিয়ে যেতেন, তাহলে হয়তো কোনোদিনই সেই তরুণী তা পেতেন না। কেউই পেতেন না। কারণ তাঁর কোনো সন্তান ছিল না। তাহলে? সেই তরুণী এবং তাঁর ভাইবোনরা কার সন্তান? মায়ের কাছে কোনো উত্তর ছিল না। তিনি জানতেন, অজ্ঞাত পরিচয় কোনো ব্যক্তি তাঁদের শুক্রাণু দান করে গিয়েছিলেন। আর সেই শুক্রাণু থেকেই তাঁর সন্তানদের জন্ম হয়েছে।
তবু মানুষ তো বরাবর নিজের পরিচয়ই খুঁজতে চায়। আর নিজের পরিচয়ের সঙ্গেই মিলেমিশে থাকে বাবা-মার পরিচয়। পরিবারের পরিচয়। তাই প্রায় ১২ বছর ধরে নিজের বাবাকে খুঁজে গেলেন সেই তরুণী। শেষ পর্যন্ত যে ডাক্তার তাঁর মায়ের গর্ভে ওই শুক্রাণু স্থাপন করেছিলেন, তাঁর সন্ধান পাওয়া গেল। কিন্তু এই ঘটনার ১৮ বছর আগেই মারা গিয়েছেন সেই ডাক্তার। ইংল্যান্ডের তরুণীটি যখন এভাবে হন্যে হয়ে নিজের বাবার পরিচয় খুঁজছেন, ঠিক সেই সময় সুদূর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু হল নতুন একটি মামলার। দক্ষিণ আফ্রিকার এক মহিলা অপারেশনের জন্য এসেছিলেন ইংল্যান্ডে। সেই ডাক্তারও বলেছিলেন, অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির শুক্রাণু থেকে জন্ম নেবে সন্তান। কিন্তু সেই সন্তান বড়ো হতেই দেখা যায় তার চেহারা অবিকল সেই ডাক্তারের মতো।
একের পর এক মামলা উঠে আসে। সারা ইউরোপে অন্তত ২০০ জন এমন তরুণ-তরুণীর সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁদের জন্ম হয়েছে কোনো ডাক্তারের শুক্রাণু থেকেই। অথবা মহিলা ডাক্তারদের স্বামীর শুক্রাণু থেকে। কোনো কোনো ডাক্তার নিজের শুক্রাণু থেকে ৭০-৮০টি শিশুর জন্ম দিয়েছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যাটা যে তার থেকে আরও অনেকটাই বেশি, তাতে সন্দেহ নেই। ইংল্যান্ডের ওই তরুণীও মনে করলেন, তাঁর জন্মও সেই ডাক্তারের শুক্রাণু থেকেই। এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সেই ডাক্তারের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাঁদের ডিএনএ পরীক্ষা করলেও নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু তাঁরা কেউই রাজি হলেন না। শেষ পর্যন্ত তরুণীটি একটি অনলাইন ডিএনএ ইন্ডেক্সে নিজের তথ্য দিলেন। যদি সেখান থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়। এরপর কয়েক মাস কেটে যায়। কোনো তথ্য আসে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে তথ্য এল, তার জন্য একেবারেই তৈরি ছিলেন না তিনি। কোনো নিকট বা দূর সম্পর্কের ভাই-বোন নয়, একেবারে তাঁর বাবার সন্ধানই পাওয়া গিয়েছে। তরুণীটি তাঁর কাছে হাজির হয়ে সবটা জানালেন। চেমসফোর্ডের সেই ডাক্তারের চেম্বারের কথাও জানালেন। তখন পুরোটা পরিষ্কার হল বৃদ্ধের কাছে। তিনি এবং তাঁর স্ত্রীও একবার গিয়েছিলেন সেই ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার তাঁর শুক্র পরীক্ষা করেছিলেন। তাহলে পরীক্ষার পর সেই শুক্রাণু তিনি নষ্ট করে দেননি। বরং তাই কাজে লাগিয়েছেন এই তরুণীর জন্মের জন্য। অথচ এক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির অনুমতিও নেননি। এখানে একসঙ্গে দুজনেই প্রতারিত হয়েছেন।
আরও পড়ুন
সাঁতার কাটতে পারে না শুক্রাণু, তিনশো বছরের ভুল ধারণা ভাঙল থ্রি-ডি মাইক্রোস্কোপ
একটি ঘটনা তো জানা গিয়েছে। কিন্তু ১৯৪৫ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত এমন কত ঘটনা ঘটেছে ইউরোপে, তার কোনো হদিশ পাওয়া সম্ভব নয়। অবশেষে ২০০২ সালে শুক্রাণু দানের বিষয়ে তথ্য রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়। ২০০৫ সালে সেই নথিতে আরও বেশি তথ্য রাখার আইনও তৈরি হয়। কিন্তু তার আগে তো এমন কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। তাই আইনের কাছেও পুরো বিষয়টা গোলমেলে। যা নিয়ে কোনো আইনই নেই, তা বে-আইনিই বা হয় কী করে? তবে তা যে প্রতারণা তাতে সন্দেহ নেই। তবে যে সময় সমাজে শুক্রাণু দান নিয়ে নানারকম কুসংস্কার বাসা বেঁধে ছিল, কুসংস্কার ছিল বন্ধ্যাত্ব নিয়েও – সেই সময় এমন প্রতারণাই হয়তো বহু মহিলাকে সমাজের কু-দৃষ্টির হাত থেকে বাঁচিয়েছে। তাই সব মিলিয়ে এমন একটা সমস্যার আইনি সমাধানের রাস্তা খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন।
আরও পড়ুন
প্রয়াত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের প্রপৌত্র, রাজপরিবারের শেষ বংশধরকে হারাল কলকাতা
তথ্যসূত্রঃ The great sperm heist: ‘They were playing with people’s lives’, Jenny Kleeman, The Guardian
আরও পড়ুন
মাদ্রাজে প্রেম ও পরে কলকাতায় বিবাহ, মাইকেল মধুসূদনের বংশধর লিয়েন্ডার পেজ
Powered by Froala Editor