মাঠা বনে মাঝেমধ্যেই ঢুঁ মারে হাতির পাল। কোকুবুরু আর মাঠাবুরু নামের দুই পাহাড়ের ওপরে যদি ওঠেন, স্বচক্ষে দেখবেন তাদের দামালপনার প্রমাণ। বুনো কুল গাছকে গুঁড়িশুদ্ধ উপড়ে ফেলে গেছে ঐরাবতের দল। আপনাদের দেখেই হয়তো এক পাথর থেকে উড়ে দূরে হুউশ করে চলে যাবে ময়ূর। সারি সারি শাল-পলাশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। ঢেউ খেলানো লালমাটির জমিতে বিছিয়ে আছে শুকনো পাতা। যেদিন গোটা চাঁদ হয়, গোটা অঞ্চলটা ভেসে যায় জ্যোৎস্নায়। কেউ যদি সে-রাতে এই বন্য পথ ধরে সামান্য হাঁটতে বেরোন, চন্দ্রাহত হওয়া ঠেকায় কে! এমনই পরির দেশে যদি গাছ-বাড়িতে রাত কাটানোর সুযোগ মেলে? কিংবা তাঁবুতে?
বরাভূম স্টেশন থেকে সাকুল্যে ২২ কিমির পথ। তারপরই বন-পাহাড়ি পথে নেমে পড়তে হবে গাড়ি থেকে। বনের ভিতর দিয়ে সামান্য এগোতেই চোখে পড়বে ‘টং-বাড়ি’। হ্যাঁ, গাছবাড়ির এমনই নাম এখানে। এই পরিকল্পনা যাঁর মাথায় খেলেছিল, সেই বরুণ ভট্টাচার্য বলছিলেন, স্থানীয় আদিবাসীদের থেকেই এই নামটা শেখা। গাছের মাথায় মাচা বেঁধে, সেখান থেকেই ফসল পাহারা দেন তাঁরা। হাতি বা বুনো শুয়োর ঢুকে এলে ক্যানেস্তারা বাজান। রাতের পর রাত সেই মাচাতেই কাটে ধানের বুকে দুধ এলে। সেই গন্ধে হাতির ঘোর লেগে যায়। তারা হুড়মুড়িয়ে ঢুকতে চায় বাগালে। আদিবাসীরা এই মাচাকে বলেন ‘টংবাড়ি’। নামটা শুনেই ভারি পছন্দ হয়ে গেছিল বরুণবাবুর।
গাছবাড়ির আকর্ষণই হল গা-ছমছমে অ্যাডভেঞ্চার। রাতের বেলায় আদিম-বন্য পরিবেশে গাছবাড়িতে রাত কাটানো মানে আজীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নেওয়া। পুরুলিয়ায় অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ পদে পদে। বন, পাহাড়, আদিম বন্যতা—সবই এখানে উজাড় করে সাজিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। পর্যটকদের তারই সুযোগ করে দিতে টংবাড়ির পরিকল্পনা।
গাছের মাথা থেকে পুরুলিয়ার ঢেউ খেলানো ভূ-গড়ন দেখলে নেশা লেগে যাবে। মায়ানমারের গাছবাড়ির মডেলে এই বাড়িগুলো তৈরি হয়েছে গাছের ক্ষতি না করেই। ঘরগুলি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। আদিমতার সঙ্গেই স্বাচ্ছন্দ্যের যুগলবন্দি এখানে রয়েছে। আর রয়েছে ভোরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙার সুযোগ। জানলা খুলতেই শীতের হাড়কাঁপানো উত্তুরে হাওয়া আর মিষ্টি রোদ আপনাকে স্বাগত জানাবে। শহুরে দূষণ থেকে অনেক দূরে একটুকরো অবসরডাঙা যেন…
টংবাড়ি ছাড়াও রয়েছে অকটাগন তাঁবুতে রাত কাটানোর সুযোগও। রাজশাহি তাঁবু যাকে বলে। তাঁবুর ভিতরেই আছে এয়ারকুলার, রেফ্রিজারেটর, ফোল্ডিং চেয়ার। থাকবে হেডল্যাম্পও। ভারতের আর কোনো ক্যাম্পে এমন ক্যাম্পিং গেজেটসের সুবিধে মিলবে না। আর উপরি পাওনা হিসেবে আছে ঢালাও অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ। যেখানে রাতে লেপার্ড এসে চুপিচুপি ছাগল বা মুরগি তুলে নিয়ে যায়, সেখানে রাত কাটানোই একটা মস্ত অ্যাডভেঞ্চার। তবে, এর সঙ্গে ক্যাম্পের ভিতরেই মিলবে বার্মা ব্রিজ, নেট ক্লাইম্বিং-এর সুযোগ। চাইলে শিখে নিতে পারেন রক ক্লাইম্বিং বা র্যা পেলিং। বন্য পথ ধরে বেরিয়ে পড়তে চান সাইকেলে? তার ব্যবস্থাও থাকছে। মাঠাবুরু বা কোকুবুরুর মাথায় উঠতে পারেন অনায়াসে। আর বন যদি আপনাকে আরো গভীরে ডাকে, সাহস সঞ্চয় করে বেরিয়েই পড়ুন না।
সন্ধেগুলো এই ক্যাম্পে বড় মায়াবী। কখনও ছৌ, কখনও বা সাঁওতালি পাতা-নাচের আসর বসে ক্যাম্পের ভিতরেই। হ্যালোজেনের আলোয় ক্যাম্প-চত্বর থইথই করে। বাইরে তখন একমাথা ঝাঁকড়া চুল নিয়ে অপেক্ষা করছে আদিম টিলা। খাওয়া-দাওয়া একসঙ্গেই। তারপর কেউ উঠে পড়বেন টংবাড়ির মাথায়, কেউ বা সিঁধোবেন তাঁবুতে।
কারও যদি ঘোর লেগে যায়, গাছে ঝোলানো দড়ির বিছানা বা খাটিয়ায় শুয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন আরও অনেকটা রাত। তারপর তারাদের সঙ্গে আলাপ শেষ হলে ঢুকতে পারেন ঘরে। তবে, অত রাতে ক্যাম্পের বাইরে বেরোনো মানা।
এই আরণ্যক নেশা থেকে অবশ্য বেরোনো মুশকিল। বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক, আকাশে একথালা চাঁদ আপনাকে পাগল করে দেবে। শীতে রোদটা বড় আদুরে। বসন্তে চারপাশে আগুন হয়ে ফুটে থাকে পলাশ। আর একটা সর্বনেশে হাওয়া দেয়। শহুরে মানুষকে উদভ্রান্ত করে দেওয়া হাওয়া। অ্যাডভেঞ্চার, গাছবাড়ি, বন, পাহাড়ের আকর্ষণ ছাড়াও এই হাওয়া, এই চাঁদের লোভেও দিব্বি ছুটে আসা যায় এখানে।
যাবেন কীভাবে?
টংবাড়ির দূরত্ব বরাভূম স্টেশন থেকে দূরত্ব ২২ কিমি, পুরুলিয়া স্টেশন থেকে ৫৪ কিমি। বুকিং থাকলে ক্যাম্পে থেকেই গাড়ি এসে নিয়ে যাবে। দুয়ারসিনি মোড়ে নেমে পায়ে হেঁটে আসা যায়।
ঘুরবেন কোথায় কোথায়?
অযোধ্যা ড্যাম, বামনি আর ঠুরগা নদীর ঝর্না, তারপানিয়া হ্রদ, পাখি পাহাড়, মুরুগুমা ড্যাম, চান্ডিল ড্যাম, ছৌ মুখোশের গ্রাম চড়িদাইয় ঘুরে আসতে পারেন গাড়ি নিয়ে। খয়রাবেরা ও পাপরাকোচা ড্যামও দেখে আসতে পারেন।
যাওয়ার সেরা সময়:
গ্রীষ্ম বাদে যে-কোনো সময় যাওয়া যায়। বসন্তকাল অবশ্যই সেরা সময়।
যোগাযোগ: বরুণ ভট্টাচার্য (৬২৮৯৩৮২২৭৭)