পরনে লাল পোশাক, মাথায় টুপি। সাদা চুল-দাড়িতে ঢাকা মুখ। ক্রিসমাস ইভে হরিণে টানা স্লেজ গাড়িতে চেপে, খেলনা, চকোলেট বোঝাই আস্ত একটি ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। চুপিসারে উপহার রেখে যান ঘুমন্ত শিশুদের বিছানার পাশে। সান্তা ক্লজের (Santa Claus) এই কিংবদন্তির সঙ্গে সকলেই পরিচিত আমরা। কিন্তু এই গল্পের জন্ম কীভাবে? এই লোককথার কোনো বাস্তব ভিত্তি আছে কি নেই, তা বলা মুশকিল। তবে সান্তা ক্লজের সঙ্গে হুবহু মিলে যায় চতুর্থ শতাব্দীর এক খ্রিস্টান সন্তের চরিত্র। এবার গবেষকরা হদিশ পেলেন সেন্ট নিকোলাস খ্যাত সেই ‘বাস্তব সান্তা’-র সমাধির।
এই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সেন্ট নিকোলাসকে (Saint Nicholas) নিয়ে কিছু কথা বলে নেওয়া যায় বরং। পিছিয়ে যাওয়া যায় প্রায় ১৭০০ বছর। বেশ কিছু নথি অনুযায়ী, এশিয়া মাইনরে সেন্ট নিকোলাসের জন্ম ২৭০ খ্রিস্টাব্দে। সে-সময় রোমান শাসনের অন্তর্গত তুরস্ক। বর্তমান তুরস্কের ডেমরে শহর অর্থাৎ, তৎকালীন মায়রার একটি বাইজেন্টাইন গির্জার বিশপ ছিলেন নিকোলাস। তবে অন্যান্য ধর্মযাজকদের থেকে একটি অন্যরকমই ছিলেন তিনি। ধর্ম বলতে তিনি বুঝতেন শুধু মানুষের পাশে দাঁড়ানোকে। সদাহাস্যময় এই গ্রিক পাদ্রীর উদারতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন তৎকালীন রোমান শাসকরাও।
শিশুরা তো বটেই, এমনকি প্রাপ্তবয়স্করাও বঞ্চিত হতেন না তাঁর এই উদার ভালোবাসা থেকে। কখনও দরিদ্র মানুষের হাতে তুলে দিতেন খাবার, কখনও বিদেশ থেকে আগত শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতেন দুর্মূল্য গ্রন্থ, ক্রিসমাসের আগের রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গোপনে শিশুদের জন্য রেখে আসতেন উপহার। দেহব্যবসা থেকে বাঁচাতে স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে তিন যুবতীকে দেশ ছেড়ে পালাতে সাহায্য করেছিলেন নিকোলাস, এমনও উল্লেখ পাওয়া যায় বহুক্ষেত্রে। সবমিলিয়ে বহু মানুষের দুর্দিনে ত্রাতা হয়ে উঠেছিলেন সেন্ট নিকোলাস। কথিত আছে, সমুদ্রের ঝড় কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগকেও অলৌকিক বলে শান্ত করতে পারতেন তিনি।
৩৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন মায়রা নগরীতেই মৃত্যু হয় নিকোলাসের। তাঁর নামানুসারেই পরবর্তীতে মায়রার এই গির্জাটির নামকরণ করা হয় ‘সেন্ট নিকোলাস চার্চ’। তবে পঞ্চম শতাব্দীতে এই গির্জাকে গ্রাস করে নেয় ভূমধ্যসাগর। জলতল বৃদ্ধির কারণে ডুবে গিয়েছিল এই গির্জার একটা বড়ো অংশ। প্রায় এক দশকের চেষ্টায়, পুরনো গির্জাটিকে ভেঙে তার ভিত্তির ওপরেই নতুন করে নির্মিত হয়েছিল আরও একটি গির্জা। সময়ের আবহে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এটিও।
বছর পাঁচেক আগে এই গির্জাটির খননকার্য শুরু করেছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। অবশ্য তখনও পর্যন্ত তাঁদের জানা ছিল না এখানেই লুকিয়ে রয়েছে বাস্তবের সান্তা তথা ‘নিকোলাস দ্য ওয়ান্ডার ওয়ার্কার’-এর সমাধি। কিছুদিন আগে প্রত্নতাত্ত্বিকদের নজর টানে এই গির্জার মেঝেতে অবস্থিত একটি দীর্ঘ ফাটল। পরবর্তীতে সেখানকার পাথর সরিয়েই গোপন কক্ষের সন্ধান পান তাঁরা। আদতে যা মূল অর্থাৎ প্রাচীন বাইজেন্টাইন গির্জাটির ভিত্তি প্রস্তর। সেখানেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল সেন্ট নিকোলাসকে, এমনটাই দাবি গবেষকদের।
‘দাবি’ বলা এই কারণেই, কেননা নিকোলাসের সমাধিক্ষেত্রের হদিশ মিললেও, সেখানে ছিল না কোনো মৃতদেহ। আসলে ১০৮৭ সালেই চুরি গিয়েছিল তাঁর দেহাবশেষ। প্রচলিত রয়েছে, নিকোলাসের জনপ্রিয়তার কারণে, এই সমাধি থেকে তাঁর দেহ বার করে, তা ইতালির বারি শহরে স্থানান্তরিত করেন ইতালীয় বণিকরা। এই বারি শহরেই তাঁর স্মরণে গড়ে তোলা হয় ব্যাসিলিকা ডি সান নিকোলা উপাসনালয়। হয়তো সকলের অজান্তে সেখানেই আজ সমাধিস্থ রয়েছে সেন্ট নিকোলাসের দেহাবশেষ। কিন্তু তা-ই যদি হয়, তবে গবেষকরা নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে তুরস্কের এই প্রাচীন গির্জাটিতেই এক সময় বিশপের দায়িত্বে ছিলেন নিকোলাস কিংবা সেখানেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল তাঁকে?
এই ধাঁধাঁর সমাধান করেছে প্রাচীন একটি ফ্রেসকো বা দেওয়ালচিত্র। যা লাল পোশাক পরিহিত খ্রিস্টান সাধু নিকোলাসেরই। তাছাড়াও মিলেছে পাথরের তৈরি একটি কফিন। তার ঢাকনাতেও খোদাই করা আঁকা রয়েছে সেন্ট নিকোলাসের প্রতিকৃতি। নিকোলাসকে যে তুরস্কেরই একটি গির্জায় সমাধিস্থ করা হয়েছিল, বিভিন্ন ঐতিহাসিক নথি থেকে তার প্রমাণ মিলেছিল বহু আগেই। কিন্তু তুরস্কের মায়রা সংলগ্ন অঞ্চলে প্রাচীন বাইজেন্টাইন গির্জার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ফলে, বাস্তব সান্তার আসল সমাধির খোঁজ পেতেই লেগে গেল কয়েক দশক…
Powered by Froala Editor