পথ দুর্ঘটনার মতো সমস্যা সব দেশের জন্যই চিন্তার কারণ। রিপোর্ট বলছে ২০২২-এ ভারতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটেছে ১ লক্ষ ৬৮ হাজার মানুষের। অর্থাৎ প্রত্যেকদিন জীবন গেছে ৪৬২ জনের। আমেরিকায় গতবছর দুর্ঘটনায় মৃত্যুসংখ্যা প্রায় চল্লিশ হাজার। অথচ জাপানে (Japan) এই সংখ্যাটা মাত্র ২১০০। ভারতের সঙ্গে জনঘনত্বের তফাৎ মাথায় রাখলেও এটুকু স্পষ্ট যে, দুর্ঘটনার হার জাপানে যথেষ্ট কম। অথচ একসময়ে সেদেশে রীতিমতো শুরু হয়েছিল ‘ট্রাফিক যুদ্ধ’ (Traffic War)। সেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল একটি কার্টুন চরিত্রের।
জাপানের রাস্তাঘাটে এখন প্রায়ই দেখা যায় হাতে আঁকা কয়েকটি বাচ্চার ছবি। কাঠের উপর আঁকা এই ছবিগুলি সাধারণত ঝোলানো থাকে কোনো ব্যস্ত মোড়ের সামনে। বিশেষ করে স্কুলের সামনে তো এদের উপস্থিতি অবধারিত। পরনে রং-বেরংয়ের পোশাক, কারোর মাথায় ঝুঁটি, তো কারোর টুপি। কেউ-বা পিঠে ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে স্কুলে। আর হাত তুলে সাবধান করছে সামনের গাড়িচালককে। বড়োজোর এক-দেড় ফুট হবে এগুলির উচ্চতা। আর এদের হাত ধরেই দ্রুতগতিতে নেমেছে জাপানের পথদুর্ঘটনা। স্থানীয় ভাষায় এদের বলা হয় ‘তোবিতা-কুন’ (Tobita-Kun)। তবে বেশি পরিচিত ‘তোবিদাশি-বউয়া’ নামে, যার আক্ষরিক অর্থ লাফানো শিশু।
এদের উৎস খুঁজতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে গত শতকের ছয়ের দশকে। পরমাণু বোমায় বিধ্বস্ত জাপান দ্রুত ফিরে আসছে নিজস্ব ছন্দে। প্রযুক্তির দুনিয়ায় নতুন বিপ্লবের জন্ম হচ্ছে প্রতিদিন। একই সঙ্গে বদলাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা। অত্যাধুনিক গাড়িতে ঢেকে যাচ্ছে টোকিও-সহ জাপানের বড়ো বড়ো শহরের রাস্তা। ফলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা। যাকে সেই সময় আখ্যা দেওয়া হয়েছিল ‘ট্রাফিক যুদ্ধ’ বলে। শুধুমাত্র ১৯৭০ সালেই দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটে ১৬,৭৬৫ জনের। তখনকার হিসেবে প্রতি এক লক্ষে মৃত্যুসংখ্যা ১৬.৩৩ জন।
সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই আবির্ভাব ‘তোবিতা-কুন’-এর। ১৯৭৩ সালে প্রথম ছবিটি তৈরি করেন শিল্পী ইয়োসেই হিসাদা (Yosei Hisada)। চরিত্রের মূল ধারণাটি অবশ্য ছিল জনপ্রিয় মাঙ্গাশিল্পী জুয়ান মিউরার। হিগাশিওমি অঞ্চলের প্রশাসনের উদ্যোগে যে ছবিগুলি ঝুলিয়ে দেওয়া হয় শহরের ব্যস্ত রাস্তায়। উজ্জ্বল রংয়ের পোশাকে সজ্জিত বাচ্চাদের দেখার জন্য নিজের থেকেই গাড়ির গতি কমিয়ে দিতেন চালকরা। তার সাহায্যেই কমতে শুরু করে দুর্ঘটনা। আজও হিসাদা ও তাঁর পুত্র আখিহিরো তৈরি করে চলেছেন ‘তোবিতা-কুন’-এর নিত্যনতুন চরিত্র। শুরুটা ‘ছেলে’ চরিত্র দিয়ে হলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘মেয়ে’রাও ঢুকে পড়েছে এই দলে। জাপানের নিজস্ব সংস্কৃতির পোশাক, জনপ্রিয় চরিত্র, এমনকি ‘নিনজা’-দের অবলম্বন করেও নির্মিত হয় কার্টুনগুলি। আবদার আসে দেশের ভ্রমণ সংস্থা, স্থানীয় স্কুল কিংবা বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে। এখনও প্রতিবছর ৫০০-র বেশি ছবি তৈরি করেন হিসাদা পরিবার।
আরও পড়ুন
জাপানি শিশুদের অনুরোধ, শুভেচ্ছাসহ ‘ইন্দিরা’কে পাঠালেন নেহরু
আবার হিরোশিমার মতো শহরে কিন্তু ততটা জনপ্রিয় নয় ‘তোবিতা-কুন’। এখানে রাস্তার ধারে লাগানো থাকে এক হাত তুলে রাস্তা পার হওয়ার ভঙ্গিতে আঁকা ছবি ‘ওয়াতারুয়ো’। নানাও শহরে গেলে দেখা মিলবে ‘জেংকি-কুন’-এর। জিরোকু ইয়ামাগিশির আঁকা পুতুলগুলির যাত্রা শুরু হয় ১৯৯১ সালে। তবে শুধু এই ছবি বা পুতুল নয়, জাপানের ‘ট্রাফিক যুদ্ধ’ সমাপ্তির একটা বড়ো কারণ লুকিয়ছিল তাদের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির মধ্যে। বুলেট ট্রেনের আবির্ভাব হোক বা বিভিন্ন শহর জুড়ে দু’লক্ষ ট্রাফিক সিগন্যাল বসানো, ধীরে ধীরে কমতে থাকে দুর্ঘটনার সংখ্যা।
আরও পড়ুন
জনশূন্যতা দূর করতেই পুতুল বানান জাপানি বৃদ্ধা
তা বলে কি ‘তোবিতা-কুন’দের গুরুত্ব কমে? একদমই না। বরং জাপানের মানুষের কাছে প্রতীক হয়ে উঠেছে এই ছবিগুলি। কিন্তু যদি হিসাদাকে জিজ্ঞেস করা যায়, কী রহস্য লুকিয়ে আছে এর সাফল্যের পিছনে? লাজুক হেসে উত্তর দেবেন তিনি, ছবিগুলি দেখতে মিষ্টি!
Powered by Froala Editor