২০১২ সাল। সে-বছর দিল্লির বুকেই ঘটে গিয়েছিল এক নারকীয় ঘটনা। চলন্ত বাসের মধ্যে গণধর্ষণ করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এক তরুণীকে। হ্যাঁ, নির্ভয়া কাণ্ডের কথাই হচ্ছে। আর সেই ঘটনার পরেই একাধিক তরজা শুরু হয়েছিল সমাজের বিভিন্ন স্তরে। সেখানে যেমন নারী নির্যাতন নিয়ে সরব হয়েছিলেন সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বরা, তেমনই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল নারী স্বাধীনতাকে। প্রশ্ন উঠেছিল যৌনতা নিয়েও।
অস্বস্তিকর সেই পরিস্থিতিই সে সময় ভাবিয়ে তুলেছিল দিল্লির আরেক তরুণীকে। স্পষ্টতই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শারীরিক চাহিদা অনেক সময়ই মানুষকে তাড়িত করে অপরাধের দিকে। মহিলারা যে শুধু বাড়ির বাইরে অপরিচিত ব্যক্তিদের থেকেই যৌন নিগ্রহের শিকার হন, তেমন নয়। বরং, বিবাহের পর বলপূর্বক যৌনতাও তো এক ধরনের ধর্ষণই। আর অপরাধের এই পথ বন্ধ করতে পারে একমাত্র উপযুক্ত শিক্ষা। আর সেই শিক্ষাপ্রদানের দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নেন দিল্লির সেই তরুণী।
পল্লবী বার্নওয়াল। তিনি নিজের পরিচয় দেন একজন ‘সেক্স কোচ’ হিসাবে। তবে পেশাগতভাবে এই পথ বেছে নেবেন তিনি, সে ব্যাপারে কোনোদিনই ভাবেননি পল্লবী। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের পর পল্লবী উপলব্ধি করেছিলেন ভারতীয় সমাজে চিরন্তন ছুঁতমার্গ হিসাবেই রয়ে গেছে যৌনতা। যৌনতা নিয়ে আলোচনা করাও যেন এক প্রকার নিষিদ্ধ আমাদের সমাজে। আর আলোচনার অভাবই যৌনতার বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা গড়ে তোলে আমাদের মনে। সেখান থেকেই জন্ম নেয় অপরাধ। এই গতে বাঁধা চিন্তাধারা ভাঙতেই তিনি প্রকাশ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা শুরু করেন যৌনতা নিয়ে। গড়ে তোলার চেষ্টা করেন এমন একটা মুক্তমঞ্চ, যেখানে যৌনতা বিষয়ে ব্যক্তিগত ধন্দের কথা খুলে বলতে পারেন যে কেউ। নিজেও নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বাকিদের সঙ্গে ভাগ করে নিতেন পল্লবী।
ব্যক্তিগত জীবনেও যৌনতা নিয়ে অস্বস্তিকর নানা পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন পল্লবী। শারীরিক চাহিদার জেরে বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্কের অধঃপতনও দেখেছেন সামনে থেকে। প্রতিটি ঘটনাই তাঁকে বার বার নতুন করে শিক্ষা দিয়েছে যৌনতা নিয়ে। এসব অভিজ্ঞতা তো ছিলই, সেইসঙ্গে যৌনশিক্ষার বিশেষ কোর্স করেন তিনি। পাঠ নেন যৌনতা সংক্রান্ত ভারতের প্রাচীন গ্রন্থাবলিরও।
আরও পড়ুন
পালাতে হয়েছিল নিজের বাড়ি থেকেও, দিনে-দিনে প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের 'মসীহা' মার্শা
কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন বহু মানুষ। তখনও দিল্লির এক বেসরকারি সংস্থায় সেলস কর্মী হিসাবেই কর্মরতা পল্লবী। তবে উদ্যোগে সাড়া পাওয়ার পর কেরিয়ারের মোড়বদল করেন তিনি। পেশাগতভাবে যৌন প্রশিক্ষকের ভূমিকাকে বেছে নেন দিল্লির তরুণী। তবে খুব একটা সহজ ছিল না কাজটা। লোকজনের তীর্যক মন্তব্য তো ছিলই, সেইসঙ্গে উপার্জনের অনিশ্চয়তাও। তবে হাল ছাড়েননি তিনি। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া তো বটেই, পাশাপাশি সরাসরি যৌনশিক্ষার ক্লাসও নেন তিনি।
আরও পড়ুন
যুদ্ধ, প্রেম, ‘বিকল্প যৌনতা’ ও হাজার তারার গল্প
পল্লবী স্পষ্টতই মনে করেন, স্কুলস্তর থেকেই বাধ্যতামূলকভাবে যৌন শিক্ষার প্রয়োজন। সেই ব্যবস্থা থাকলে যৌন অপরাধের সংখ্যা কমে আসবে অনেকটাই। পাশ্চাত্যের একাধিক দেশের উদাহরণ দিয়েই তিনি দেখাচ্ছেন, যে সকল দেশে যৌনশিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে অপরাধের পরিমাণ কম। পাশাপাশি হ্যাপি ইন্ডেক্সেও ভারতের থেকে বহুগুণ এগিয়ে রয়েছে সেইসব দেশ। অন্যদিকে আমাদের দেশে উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে যৌন নির্যাতনের ঘটনা। পাশাপাশি পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ করার পরও বিশ্বের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ওয়েবসাইটগুলিতে সবথেকে বেশি ভিড় থাকে ভারতীয় দর্শকদেরই।
আরও পড়ুন
ধর্ষণ শুধুই যৌনাঙ্গ-নির্ভর নয়; যৌনতার ভাষা শিখতে হবে প্রথমে : মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়
সমাজকর্মীদের একাধিক আন্দোলনের পর বছর তিনেক আগে স্কুলপাঠ্যে যৌনশিক্ষার অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল কেন্দ্র। কিন্তু তার বাস্তবায়ন নিয়ে বিন্দুমাত্র ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সে রাজ্য প্রশাসনের ওপর ছেড়ে দিয়েই খালাস কেন্দ্র। এমত অবস্থায় তাই অন্ধকারাচ্ছন্ন মনোভাব কাটাতে একাই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন পল্লবী। বিশেষভাবে জোর দিচ্ছেন অভিভাবকদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে। পল্লবী জানাচ্ছেন, সন্তানকে যৌনশিক্ষার প্রাথমিক পাঠ দেওয়া অভিভাবকদেরই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। পল্লবী নিজেও আট বছরের পুত্র সন্তানের মা। নিজের সন্তানকেও উপযুক্ত বয়সে সঠিক প্রশিক্ষণ দেবেন বলেই জানাচ্ছেন তিনি।
ইতিমধ্যেই টেড টক-সহ একাধিক আন্তর্জাতিক মঞ্চে যৌনতা নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন পল্লবী। ধীরে ধীরে যে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে, তাও নজরে এসেছে তাঁর। তবে প্রশাসনিক স্তর থেকে যৌনশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হলে গতি বাড়বে এই পরিবর্তনের। কমে আসবে ভারতে অপরাধের পরিসংখ্যানও। সে ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী ৩৮ বছরের দিল্লির তরুণী…
Powered by Froala Editor