কফিনের উপর একটি ঝুলন্ত ঘণ্টা। আর সেটার সঙ্গে লাগানো একটি ফিতে, কফিনের ওপরের ছোট্ট গর্ত দিয়ে ঢুকে গেছে ভেতরে। তবে কি মিশরীয়দের মতো মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের কথা ভেবেই এমন কফিন নির্মাণ, যাতে মৃত ব্যক্তি সাহায্যের আর্জি জানাতে পারে ঘণ্টা বাজিয়ে? না, কোনো ধর্মীয় আচার কিংবা রীতি জড়িয়ে নেই এর সঙ্গে। বরং, জীবিত অবস্থায় সমাধিস্থ হওয়ার ভয় থেকেই ইউরোপে ‘জনপ্রিয়’ হয়ে উঠেছিল এই আশ্চর্যকর কফিন।
সময়টা আঠারো শতকের শেষ দিক। তখন কলেরার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ইউরোপ জুড়ে। বাড়িতে বাড়িতে তখন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে কলেরায়। কিন্তু সে দেহ খোলা পড়ে থাকলে যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে রোগের জীবাণু। যা আরও ত্বরান্বিত করবে মহামারীকে। তাই প্রাণস্পন্দন থেমে গেলেই কফিনবন্দি করে সমাধিস্থ করা হত মানবদেহ। চিকিৎসক ডেকে এনে মৃত্যু নিশ্চিত করার সুযোগটা পর্যন্ত পেতেন না মৃতের আত্মীয়রা।
এই ঘটনাই একপ্রকার ত্রাস তৈরি করেছিল তৎকালীন সমাজে। যদি সত্যিই কোনো জীবিত মানুষকে কবর দেওয়া হয় মৃত বলে? সেই ভয় থেকেই এই বিশেষ কফিন জন্ম নেয় ব্রিটেনে। যা পরবর্তীকালে পরিচিত হয়ে ওঠে ‘সেফটি কফিন’ নামে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ পরিবর্তিত হয়েছে এই কফিনের চেহারা। সংযুক্ত হয়েছে নিত্যনতুন প্রযুক্তি।
সেটা ১৭৯১ সাল। ম্যাঞ্চেস্টারের এক উদ্ভাবক রবার্ট রবিনসন প্রথম নিজের জন্য তৈরি করেন এই বিশেষ ধরনের কফিন। সে কফিনের ভেতরে মৃতদেহ শায়িত করার জায়গার ঠিক ওপরেই ছিল একটি কাচের প্যানেল। ছিল বিশেষ দরজাও। রবিনসন আত্মীয়দের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেন প্রতিদিন তাঁরা এসে পরীক্ষা করে যান সেই কাচের ফলকে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কারণে বাষ্প জমেছে কিনা।
আরও পড়ুন
বাংলা থেকেই জন্ম ‘বাংলো’র, ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপ-আমেরিকাতেও
ঠিক পরের বছরই এই প্রযুক্তিতে বেশ কিছু বদল এনে সেফটি কফিন তৈরি করান স্বয়ং ব্রান্সউইকের ডিউক ফার্দিনান্দ। সেখানে আরামদায়ক গদি থেকে শুরু করে ছিল কাচের জানলা, ভেন্টিলেটর, বাইরে থেকে খাবার খাওয়ানোর নলও। পাশাপাশি কফিনের ঢাকনার তালা খোলার ব্যবস্থা ছিল দু’দিক থেকেই। পরবর্তীতে ফার্দিনান্দের মৃত্যুর পর সেই দরজার একটি চাবি রেখে দেওয়া হয়েছিল তাঁর পকেটে। যাতে আপদকালীন পরিস্থিতিতে তিনি দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে পারেন।
আরও পড়ুন
শুধুই প্রেম নয়, হানিমুনের সঙ্গে জড়িয়ে অপহরণ ও ‘লুকিয়ে রাখা’র ইতিহাসও!
খোদ ডিউকের সেফটি কফিন ব্যবহার দেখেই পরবর্তীতে বহু মানুষ হাঁটেন এই পথেই। মৃত্যুর আগে নিজের জন্য পছন্দসই সেফটি কফিন কিনে রাখতেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। সেফটি কফিনে ঘণ্টার ব্যবহার শুরু হয় এরও প্রায় এক শতাব্দী পরে। ১৮৯২ সালে ডঃ জোহান গডফ্রাইড ট্যাবারগার কফিনের সঙ্গে সংযোজন করেন অভিনব ‘কলিং বেল’। কফিনের বাইরে অবস্থিত সেই ঘণ্টার সঙ্গে সংযুক্ত সুতো বেঁধে রাখা হত শায়িত মৃতদেহের হাতে। যাতে তিনি জীবিত থাকলে ন্যূনতম প্রচেষ্টাতেই সাহায্যের জন্য আবেদন করতে পারেন সমাধিক্ষেত্রের পাহারাদারদের কাছে।
আরও পড়ুন
গুটেনবার্গের জন্মের আড়াইশো বছর আগেই মুদ্রণযন্ত্র; ইউরোপ নয়, পথ দেখিয়েছিল এশিয়াই!
তবে মাঝেমধ্যেই এহেন কফিনের জন্য বাড়তি সমস্যায় পড়তে হত সেমেট্রির পাহারাদারদের। মৃতদেহের পচনে মৃত ব্যক্তির শরীর ফুলে গেলেই টান পড়ত ঘণ্টার সঙ্গে সংযুক্ত সুতোয়। আর বিপদ সংকেত পেয়ে ছুটে আসতেন রক্ষীরা। তারপর মহাসমারোহে কফিন খোলার পর ব্যর্থ মনোরথেই বাড়ি ফিরতে হত মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দের। কিন্তু আদৌ কতটা সুরক্ষা দিতে পেরেছিল এই সেফটি কফিন? লিখিত রেকর্ড বলছে, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে একজন মানুষেরও প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়নি কোনোদিন। অর্থাৎ, বলা যেতে পারে সম্পূর্ণই বৃথা গিয়েছিল এই আবিষ্কার। তবে কার্যকরী না হলেও, মহামারীর আবহে মানুষকে জীবিত অবস্থায় মৃত্যুভয় থেকে যে খানিক মানসিক স্বস্তি দিয়েছিল এই কফিন, তাতে সন্দেহ নেই কোনো…
Powered by Froala Editor