কথায় রয়েছে, যুদ্ধে আর প্রেমে জয় ছিনিয়ে নিতে সমস্ত পথই ‘নৈতিক’। সেদিন থেকে দেখতে গেলে বাণিজ্যও তো একটা যুদ্ধই বটে। আর সেই কারণেই ভুলে জেনেও মুখ বুজে তুরস্কের সরকারের ‘হুকুম’ পালন করেছে ফেসবুক। সম্প্রতি প্রকাশ্যে এল ফেসবুকের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কার্যনিবার্হকের সেই সংক্রান্ত ইমেল। যা কিনা পাঠানো হয়েছিল খোদ প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকেরবার্গকেই।
পিছিয়ে যাওয়া যাক বছর তিনেক। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস। তুরস্কের সেনাবাহিনীর ভয়ঙ্কর হামলার মুখোমুখি হয়েছিল উত্তর সিরিয়ার আফ্রিন প্রদেশ। সেই আক্রমণের কারণ লক্ষ্য মূলত কুর্দিশ সংখ্যালঘুরাই। পাল্টা আঘাত হেনেছিল সিরিয়ার পিপল’স প্রোটেকশন ইউনিট ওয়াই.পি.জি। তবে হতাহতের বিষয় শুধুমাত্র সীমাবদ্ধ থাকেনি সেনানীদের মধ্যে। প্রাণ হারিয়েছিলেন বহু সাধারণ মানুষ।
যুদ্ধের সেই ভয়াবহতার ছবি এবং ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ্যে এনেছিল ওয়াইপিজি। তারপরেই সূত্রপাত বিতর্কের। সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় সেই দৃশ্য প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল তুরস্কের অন্দরমহলেও। ছড়িয়ে পড়েছিল কয়েক হাজার ওয়েবসাইটে। এমনকি গ্রেপ্তার হতে হয় তুরস্কেরও কয়েকশো সমালোচককেও। এই প্রতিরোধ দমন করতেই ফেসবুকের কাছে দ্বারস্থ হয় তুরস্ক প্রশাসন। তুরস্কের সরকার এবং সামরিক বাহিনীর থেকে আবেদন করা হয় ওয়াইপিজি’র পেজটি সরিয়ে ফেলার জন্য।
তবে পরিসংখ্যান বলছে, শুধু তুরস্ক ও রাশিয়া থেকে ফেসবুকের আয় গোটা ইউরোপের আয়ের থেকেও বেশি। গত বছর তুরস্কে ব্যবহারকারী-পিছু আয় বেড়েছিল ৩৪ শতাংশ। কাজেই তুর্কি সরকারের ‘আদেশ’ অমান্য করলে প্রায় কয়েক কোটি ব্যবহারকারী হারানোর আশঙ্কা দেখা দেয় ফেসবুকে। সদ্য প্রকাশ্যে আসা ফেসবুকের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কার্যনির্বাহক জোয়েল কালপানের মেলটি ঠিক সেই সময়েরই।
আরও পড়ুন
ফেসবুক মার্কেটপ্লেসেই বিক্রি হচ্ছে আমাজনের বনভূমি, প্রশাসনের নাকের ডগায় বে-আইনি ব্যবসা
তিনিই ফেসবুকের উচ্চস্তরীয় কর্মকর্তাদের পাঠান জিও-ব্লকের প্রস্তাব। আসলে এই প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি কোনো পেজ সরিয়ে না ফেলেও কোনো ভৌগলিক অবস্থানে ব্লক করে রাখা সম্ভব। পরবর্তীতে ঠিক সেই পথটাই বেছে নিয়েছিল ফেসবুক। সায় দিয়েছিলেন চিফ ওপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ। যে ‘ব্যান’ তুরস্কে বজায় রয়েছে আজও। কিন্তু তুরস্কের অভ্যন্তরের সংবাদমাধ্যমগুলিকেই যখন মুখ বন্ধ করে রেখেছে তুরস্ক, তখন এই ঘটনা প্রকাশ্যে এল কীভাবে?
নিউইয়র্কের বেসরকারি সংস্থা এবং ‘তদন্তকারী সংবাদমাধ্যম’ প্রোপাবলিকা সম্প্রতি তুরস্কের ‘ভিপিএন’ বা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ওয়াই.পি.জি’র পেজে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার পাতাটির কোনো অস্তিত্ব নেই বলেই দেখান হয় ফেসবুকের তরফে। অথচ পৃথিবীর অন্য সকল প্রান্ত থেকেই দিব্যিই ব্যবহার করা যাচ্ছে পাতাটি। তদন্তে তাঁরাই তুলে আনে ২০১৮-র সেই বিতর্কিত ই-মেলটি।
আরও পড়ুন
পাঁচ মাসে মৃত ১৫ লক্ষ, ইতিহাসের অন্যতম বিধ্বংসী যুদ্ধ ‘ব্যাটল অফ সমে’
বাক-স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ফেসবুকের এই পদক্ষেপই এখন প্রশ্নের মুখে। বিশ্বের অন্যতম সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের। শুধু সমালোচকরা নন, এই দাবি তুলেছে স্বয়ং ওয়াই.পি.জি। মায়ানমার হোক কিংবা বেলারুশ— বর্তমানে একাধিকবার সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের পরেও সোশ্যাল মিডিয়াই বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছে বাস্তব পরিস্থিতিকে। সিরিয়ার বক্তব্যও একই— বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠন এবং চরমপন্থীদের আক্রমণকেই এই পেজের মাধ্যমে তুলে ধরত তাঁরা, বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিত যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার প্রকৃত দৃশ্য। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ফেসবুকের এই পদক্ষেপকে ‘বাকস্বাধীনতা’-য় গুরুতর আঘাত ছাড়া আর কীই বা বলা যেতে পারে?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
লাইব্রেরি থেকে উদ্ধার কবি অ্যান্ড্রু প্যাটারসনের ১২০ বছরের পুরনো চকলেট, জড়িয়ে যুদ্ধের ইতিহাসও