একই অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন তাঁরা। প্রতিবেশীরা বলতেন, “ওঁরা তো নিছক বন্ধু।” শুধু কি বন্ধু? সমাজের তথাকথিত চিন্তাধারার বাইরে গিয়ে তাঁরা একে অপরকে ভালবেসেছিলেন। নিজেদের ‘পুরুষ’ লিঙ্গ পরিচয় সেখানে বড় হয়ে দাঁড়ায়নি। এককালের প্রতিবেশী, আজ জীবনের সেই বিশেষ মানুষটি হয়ে উঠেছেন। কেরালার নিকেশ পি পি এবং সোনু এম এস সেখানকার সে-রাজ্যের প্রথম বিবাহিত গে দম্পতি। তাঁদের যাত্রা, সত্যিই পাল্টে দেয় আমাদের যাবতীয় দৃষ্টি…
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঘরোয়া অনুষ্ঠানে নিকেশ-সোনু’র চার হাত এক হয়েছে। একে অন্যের আঙুলে আংটি পরিয়ে করেছেন বিয়ে। কিন্তু সমাজ, ধর্ম— না, এখনও মানেনি এই বিয়ে। এমনকি, সরকারি ভাবে রেজিস্টারও হয়নি। তারই উদ্যোগ নিচ্ছেন তাঁরা। ‘স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে যাতে তাঁদের এই সমকামী বিয়েটা আইনত স্বীকৃতি পায়, সেইজন্য কেরালা হাইকোর্টে দ্বারস্থ হয়েছেন দুজনে।
প্রহরের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল নিকেশ-সোনু’র সঙ্গে। এটি কোর্টের বিচারাধীন বিষয় বলে আপাতত আর কিছু মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছেন ওরা। অপেক্ষা করছেন কেন্দ্র সরকারের উত্তর এবং কোর্টের রায়ের জন্য। কাজের মধ্যে দিয়েই ফুটে উঠেছে তাঁদের যা-কিছু বলার।
ওঁদের প্রশ্নও খুব সঙ্গত। পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই সমলিঙ্গের বিবাহ আইনত বৈধতা পেয়েছে। সমকামিতা যে অপরাধ নয়, কোনও মানসিক ব্যাধি নয়; বরং অন্য অনেক কিছুর মতই এটাও স্বাভাবিক ঘটনা— সেটা প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছে একবিংশ শতকের আধুনিক বিশ্ব। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, আমাদের সমাজের ছবিটা কি বদলেছে?
নিকেশ, সোনু এবং আরও অনেকের মতে, না। বদলায়নি। ভালবাসা, বিয়ে, সংসার, যৌনতা— আজও সমাজের চোখে এইসব কিছুর সঙ্গে জুড়ে আছে বিষমলিঙ্গ। সমকামিতা, সমলিঙ্গের বিয়েও যে ওই সবকিছুর মতই সহজ, স্বাভাবিক, সেটাই মানেন না তাঁরা। কিন্তু ভারতের সংবিধান? ভারতের আইন? ৩৭৭ ধারা উঠিয়ে সমকামিতাকে বৈধ ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। সমলিঙ্গের বিয়ে নিয়ে তাঁদের অবস্থান এখনও স্পষ্ট করেননি তাঁরা।
সেটা স্পষ্ট করতেই নিকেশ আর সোনু-র এই উদ্যোগ। স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্টেও সমলিঙ্গের বিয়ে নিয়ে কোনো উল্লেখ নেই। এখানেই বদল চান তাঁরা। ভাবাতে চান সমাজের বাকি মানুষদের। সমকামীরাও যে মানুষ, তাঁদেরও যে নিজস্ব যৌন চাহিদা রয়েছে, আর সেটা যে অন্যায় নয়— এই কথাটাই জোর গলায় বলছেন তাঁরা। নিজেদের দিয়েই এই বদল আনবেন, এই বিশ্বাস তাঁদের। ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে অন্যান্য সমকামী মানুষরাও, যারা সাহস করে নিজের ভালবাসার মানুষটির সঙ্গে থাকতে পারছেন না। প্রত্যেকেরই নিজের মতো করে বেঁচে থাকার অধিকার আছে; অন্তত সংবিধান, আইন সেই অধিকার দিয়েছে। তাহলে কেন এই বৈষম্য? এর বিরুদ্ধেই জেহাদ নিকেশদের। আপাতত, রায়ের অপেক্ষায় সবাই…