ব্যাঙ্গালোরের অনতিদূরে শাকলেসপুর হিল স্টেশন দেখতে ভিড় জমান অনেকেই। পশ্চিমঘাট পর্বতের উপর মনোরম পরিবেশে ছুটি কাটাতে যাঁরা যান তাঁরা অনেকেই হয়তো খোঁজ রাখেন না, এই শাকলেসপুরেই আছে অষ্টাদশ শতকের বিখ্যাত ফরাসি সামরিক প্রযুক্তির এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। মঞ্জারাবাদ দুর্গ। আটমুখী তারার মতো দেখতে এই দূর্গ তৈরি হয়েছিল ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে, টিপু সুলতানের আমলে। টিপু তখন মহীশূর সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য লড়াই করছেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে। ব্রিটিশের সঙ্গে তখন আছে মারাঠা ও নিজামের সেনাবাহিনী। অন্যদিকে টিপুর পিতা হায়দার আলির সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিল ফরাসিরা। টিপুর সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের ভার ন্যাস্ত ফরাসিদের উপর। ইতিমধ্যেই ফ্রান্সে সামরিক স্থাপত্যের জগতে বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনার ছাপ রেখেছেন সেবাস্তিয়ান লে পস্ত্র দে ভউবন।
ইংরেজ, মারাঠা ও নিজাম -- এই ত্রিবিধ শক্তির হাত থেকে নিজের রাজ্যকে রক্ষা করতে ম্যাঙ্গালোর বন্দর ও রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তমের মধ্যবর্তী সরকার উপর করা নজরদারি রাখতে চাইলেন টিপু। মঞ্জারাবাদের দুর্গটি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেই উঁচু জায়গাটাই আদর্শ মনে করেন। আধুনিক দুর্গ নির্মাণের জন্য ডাক পড়ল ফরাসি স্থপতিদের। ফরাসি কায়দার এই দূর্গটির দেয়ালে দেয়ালে আছে ইসলামিক স্থাপত্যরীতির কারুকার্য। দূর্গের ঠিক মাঝখানে ক্রস চিহ্নের মত ট্যাঙ্কটি বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য তৈরি। অস্ত্রশস্ত্র মজুত রাখার পাশাপাশি সৈন্যদের বিশ্রামের জন্য উত্তরদিকে তৈরি করা হয় লম্বা আর্চ। আকাশ পরিষ্কার থাকলে দুর্গের উপর দাঁড়িয়ে আরব সাগর পর্যন্ত দেখা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, যুদ্ধের সময় এই দুর্গ কোনো কাজে লাগেনি। কারণ আকাশ ঘন কুয়াশায় আবৃত ছিল।
সামরিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ নতুন নতুন গবেষণায় উৎসাহ দিতেন টিপু সুলতান। যুদ্ধে রকেট উৎক্ষেপণ করার প্রযুক্তি তিনিই ব্যবহার করেছিলেন, এ তথ্য আমরা সবাই জানি। মঞ্জারাবাদ দুর্গ সামরিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর আরেকটি অভিনব দৃষ্টান্ত। তবে ভারতবর্ষে এটিই একমাত্র তারকাকৃতি দুর্গ নয়। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দেশের দ্বিতীয় তারকাকৃতি দুর্গ। দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা সংস্থার তত্ত্বাবধানে থাকলেও প্রাচীন এই সৌধটির উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না বলেই অভিযোগ তুলছেন অনেকে। নিয়মিত পরিচর্যার কোনো ব্যবস্থা নেই। পর্যটকদের আনাগোনা অবশ্য খুব কম নয়। কিন্তু সেখানেও কোনো নিয়মানুবর্তিতা নেই। ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা এইসব ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে যেমন এগিয়ে আসতে হবে, তার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে সমস্ত মানুষকে। ইতিহাস ভুলে গেলে আমরা শেষ পর্যন্ত শিকড়হীন হয়ে পড়ব। বাঁচিয়ে রাখার দায় আমাদেরই।