ঘরের মধ্যে থমথমে পরিবেশ। চেয়ারে বসে আছে টিনটিন। সামনে সমানে পায়চারি করে যাচ্ছেন ক্যাপটেন হ্যাডক। টিনটিনের উদ্দেশ্যেই বিড়বিড় করছেন, “বদমাশটা ক্যালকুলাসকে চুরি করল কেন? কারণ কী?” টিনটিনের পাশে মেঝেয় বসে এই দৃশ্য অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে কুট্টুস। প্রফেসর ক্যালকুলাস আবারও বেপাত্তা।
ছবি, কথা হুবহু কমিক্সের মতোই থাকল। তবে চরিত্রগুলোর নাম ক্যাপটেন হ্যাডক আর টিনটিন থেকে পালটে যদি নিউটন আর লিবনিজ করে দেওয়া যায়? তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে যাবে গণিতের ক্যালকুলাসের কথা। অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকেই চলছে সেই বিতর্ক। এই দুই বিখ্যাত বিজ্ঞানীর মধ্যে ক্যালকুলাসের প্রথম প্রবর্তক কে?
হার্জের তৈরি চরিত্র টিনটিন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর হাত ধরেই ঢুকে পড়েছিল বাংলা সাহিত্যে। তবে সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কিছু পাতায় এখন ছেয়ে গেছে টিনটিন, ক্যাপটেন হ্যাডক, ক্যালকুলাস, জনসন-রনসনরা। পরিচিত চরিত্রগুলো একই আছে। শুধু পাল্টে গেছে তাদের ভূমিকা। কখনও তাদের মুখে উঠে আসছে বিজ্ঞানের সমীকরণ, কখনও ইতিহাস, খেলা। আবার কখনও সাম্প্রতিক ঘটনা। টিনটিন চিরকালই নির্মেদ আনন্দের, কিন্তু প্রেক্ষাপট পাল্টে যাওয়ায় বদলে যাচ্ছে হাসির রোলের দিকও। ফেসবুকে এমনই দুটি পেজ ‘বঙ্গীয় মিমিক্স পরিষদ’ এবং ‘টিনটিন বাংলা কমিক্স দিয়ে বানানো নোংরা মিম’। কিন্তু নামে ‘নোংরা’ হলেও আদতে নয়। বরং তা শ্লীল, পরিমার্জিত, রুচিশীল। দুই পেজের অ্যাডমিনরাই তরুণ-তরুণী, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। কেউ বা সদ্য পড়াশোনার গণ্ডি পেরিয়ে চাকরিতে ঢুকেছেন।
‘মিম’-কালচার বাংলায় নতুন নয়। বিগত কয়েক বছর ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আস্তে আস্তে পসার জমিয়েছে মিম। কোভিডের লকডাউনে যার রাজত্ব বেড়েছে আরও কয়েকগুণ। এবং এই লকডাউনই জন্ম দিয়েছে এই দুই মিম পেজের। কিন্তু প্রচলিত মিম টেমপ্লেটগুলিকে ছেড়ে টিনটিনকেই বেছে নেওয়া কেন? তার কারণ খুঁজতে গিয়েই উঠে এল, জনপ্রিয় এই চরিত্রের প্রতি ভালবাসা ছাড়াও রয়েছে অন্য আরও কারণ। “টিনটিনের ক্ষেত্রে টেমপ্লেট এবং চরিত্রদের কথা প্রায় রেডিমেড। শুধু উপযুক্ত পরিস্থিতি মাফিক ক্যাপশন জুড়লেই তা চেহারা নিচ্ছে অনবদ্য মিমের। পাশাপাশিই টিনটিন বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশেই ঘুরে ফেলেছে। এমনকি চাঁদেও পাড়ি দিয়েছে সে। ফলে প্রয়োজনীয় যাবতীয় ফ্রেম টিনটিনের বই থেকে জোগাড় করা অত্যন্ত সহজলভ্য”, জানাচ্ছেন ‘বঙ্গীয় মিমিক্স পরিষদ’-এর এক অ্যাডমিন। আবার ‘টিনটিন বাংলা কমিক্স দিয়ে বানানো নোংরা মিম’-এর অ্যাডমিনের ভাষায়, “একদম ছোটোবেলায় নন্টে-ফন্টে, বাঁটুল পড়েছি আমরা। আরেকটু বড়ো হতে টিনটিন। কিন্তু নন্টে-ফন্টে কিংবা বাঁটুলের থেকেও টিনটিন অনেক বেশি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছিল আমাদের প্রজন্মে। তাই বড়ো হলেও তার প্রসঙ্গে বার বার ফিরে এসেছে আমাদের মধ্যে। ভালবাসা ছাড়াও তার ব্যাপ্তি অনেকটাই দায়ী এই কমিক্সকে মিমের উপকরণ হিসাবে বেছে নেওয়ার জন্য।”
আরও পড়ুন
কার্টুনের লড়াই নেমে আসত ময়দানেও, বে-ব্লেড ও আমাদের হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা
মিম সংস্কৃতি গৃহবন্দি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে মজা, পৌঁছে দিয়েছে সাম্প্রতিক বিতর্ক, সংবাদ এবং আরও আরও অনেক কিছুই। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই খোরাক হয়ে উঠছে নীতিনির্ধারক। মিম কোথাও যেন ব্যক্তিবিশেষে তকমা আটকে দিচ্ছে ‘দোষী’-র। ঘোষণা করছে ভার্ডিক্ট। তার আক্রমণের ফলা আঘাত করছে সাম্প্রতিক তারকা থেকে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদেরও। ঠিক এমনই একটা ডামাডোলে দাঁড়িয়ে টিনটিনের এই মিমগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য, তা ব্যক্তিগত আক্রমণ করে না কাউকেই। বরং নির্মেদ আনন্দ দেওয়াই তার মূল উদ্দেশ্য।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলি ব্যাঙ্গাত্মকভাবে ফুটিয়ে তোলার পিছনে বড়ো ভূমিকা পালন করে আসছে মিম। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বাংলায় তৈরি কার্টুনে বার বার প্রতিফলিত হলেও বাংলা কমিক্সে তার খামতি থেকে গেছে চিরকালই। হয়তো সতর্কভাবেই 'হাঁদা ভোঁদা', 'নন্টে-ফন্টে', 'বাঁটুল দি গ্রেট'-এর মতো জনপ্রিয় কমিক্সগুলিতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে রাজনীতিকে। অন্যদিকে হার্জ-রচিত টিনটিনের প্রায় সব কমিক্সেই কমবেশি এসেছে বিশ্বরাজনীতির প্রসঙ্গ। তবে এখন তার কথা অপরিবর্তিত থেকেই প্রেক্ষাপট বদলে যাচ্ছে ভারতীয় সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। তার বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনা বার্তা দিচ্ছে অনিশ্চয়তার দোলাচলে দুলতে থাকা সময়ের সম্পর্কে। বাংলা কমিক্সের সেই ঘাটতিই সম্প্রতি খানিকটা পূরণ করছে টিনটিনের এই মিমগুলি।
আরও পড়ুন
কার্টুন আঁকলেন গগনেন্দ্রনাথ, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে হানা দিল পুলিশ
যেকোনো শিল্পের বিষয়বস্তু রাজনীতি হলেই তাকে এক শ্রেণীর রোষের মুখে পড়তে হয়। তবে টিনটিনের এই মিমগুলির সুবাদে কোনোদিন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি বলেই জানাচ্ছেন 'বঙ্গীয় মিমিক্স পরিষদ'-এর এক অ্যাডমিন। প্রতিটি কাজের পিছনে থাকা বুদ্ধিমত্তাই হয়তো তার কারণ। প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি জানান, 'সাহিত্যেও এর অন্যথা নেই। প্রফেসর শঙ্কু কিংবা ফেলুদার মতো চরিত্র মিমের উপস্থাপিত হলে তা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েই থাকে। কিন্তু টিনটিন যেহেতু একটি বিশ্বজনীন চরিত্র, তাই এই বিষয়গুলি টিনটিনের ক্ষেত্রে অনেকটাই অনুপস্থিত। কোনো চরিত্র যখন বিশ্বজনীন হয়ে যায়, তখন তাঁকে নিয়ে সাধারণের সংরক্ষণশীল মনোভাবটাও আর থাকে না।” বক্তব্য অনেকটাই এক অন্য পেজটির অ্যাডমিন সৌরভ মণ্ডলের, “এর আগে যখন টিনটিন ছাড়া মিম বানাতাম। এমন সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছিল একবার। সেই বিতর্কে সরাসরি আমার নাম জড়ায়নি যদিও। তাও সেই ঘটনা শিখিয়ে দিয়েছিল যখন হিউমারকে পরিবেশন করা হয়, তা যেন উঁচু মাত্রার হয়। মানুষ তার থেকে যেন মজাটাই পায়। কিন্তু অন্তর্নিহিত বার্তা বুঝতে গেলে যেন পাঠককেও রুচিশীল, যুক্তিবাদী হয় হয়।”
আরও পড়ুন
দুষ্প্রাপ্য মহাভারত হোক বা কমিকস – কলকাতায় পুরনো বইয়ের ‘দেবদূত’ এই দীপঙ্করবাবুরাই
টিনটিন, এই জনপ্রিয় কমিক্স চরিত্র আশি-নব্বই দশকের প্রজন্মের কাছে এক অন্য নস্টালজিয়া। এক অন্য আবেগ জড়িয়ে আছে তার সঙ্গে। কিন্তু সময়ের চাকা কি তার জনপ্রিয়তাকে পিষে দিয়ে যাচ্ছে? আজকালকার কিশোর-কিশোরীরা কতটা আগ্রহী টিনটিনের ব্যাপারে, তা প্রশ্নচিহ্নের মুখে। 'বঙ্গীয় মিমিক্স পরিষদ'-এর দর্শকদের পরিসংখ্যানেই তা ফুটে উঠছিল। অ্যাডমিন জানাচ্ছিলেন ২০ বছরের কম-বয়সী দর্শকদের সংখ্যা একেবারেই কম। টিনটিনের এই মিমগুলোর সঙ্গে সবথেকে বেশিভাবে মিলিয়ে নিচ্ছেন ২০-৪০ বছরের পাঠক দর্শকরাই। কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও মার্ভেল, ডিসি, ডিজনি'র সিনেমার যুগে দাঁড়িয়ে এই মিমগুলোই অদৃশ্যভাবে লড়ে যাচ্ছে টিনটিনের গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখার জন্য। দুটি মিম পেজের অ্যাডমিনরাই জানাচ্ছেন, অনেকেই মিম দেখে আগ্রহী হয়ে খোঁজ নিচ্ছেন এই কমিক্সের ব্যাপারে। জানতে চাইছেন বইগুলির নাম। এ এক অঘোষিত সাফল্যেরই শিলালিপি।
টিনটিনকে অন্য মোড়কে উপস্থাপনা করা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কাজ। কিন্তু শুধুই কি টিনটিন? আগামী প্রজন্মের থেকে মুছে যাচ্ছে হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল, বাহাদুর বেড়ালের মত বাংলা কমিক্সগুলিও। ‘বঙ্গীয় মিমিক্স পরিষদ’ কিংবা ‘টিনটিন বাংলা কমিক্স দিয়ে বানানো নোংরা মিম’-এর কাজগুলি দেখে অন্যান্য তরুণরা কি এগিয়ে আসবে এই চরিত্রগুলির মধ্যে দিয়েও সাধারণের জন্য ‘খোরাক’ তুলে আনার জন্য? নাকি তাঁদের দেখানো পথেই ট্রেন্ড বজায় রেখে টিনটিনের মিমে আরও জোর দেবে বেশি করে? এখন সেটাই দেখার...
ছবি সৌজন্যে - ‘টিনটিন বাংলা কমিক্স দিয়ে বানানো নোংরা মিম’ এবং ‘বঙ্গীয় মিমিক্স পরিষদ’
Powered by Froala Editor