সালটা ১৭৭৮। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে মুঙ্গের পৌঁছলেন অগস্ট ক্লিভল্যান্ড। জঙ্গলমহলের অর্থনীতিতে সে এক বিরাট ঘটনা। ক্লিভল্যান্ড আদিবাসীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য তাঁদের ভাষা শিখলেন। একাত্ব হতে শুরু করলেন তাঁদের সংস্কৃতির সঙ্গে। আদিবাসী মানুষরাও যেন ক্রমশ আপন করে নিতে শুরু করলেন এই বিদেশি মানুষটিকে। কৃষকদের খাজনা মুকুবের জন্যও ক্লিভল্যান্ড সাধ্যমতো চেষ্টা করতে শুরু করলেন। কিন্তু, এই সমস্তকিছুর মধ্যে লুকিয়ে ছিল একটি প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য। আদিবাসীদের বন্ধু হতে নয়, ক্লিভল্যান্ড এসেছিলেন ব্রিটিশ পুলিশের খাতায় অন্যতম কুখ্যাত আততায়ীকে পরাস্ত করতে। তাঁর নাম তিলকা মাঝি। আদিবাসী মানুষদের কাছে ইতিমধ্যে তিনি একজন বীর নায়ক হয়ে উঠেছেন।
তিলকা মাঝি পাহাড়িয়া না সাঁওতাল সে-বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। পুলিশের খাতায় তাঁকে পাহাড়িয়া বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। ‘তিলকা’ শব্দটিও পাহাড়িয়াদের ভাষায় ব্যবহৃত হয়। তবে পাহাড়িয়া এবং সাঁওতাল দুই উপজাতির মানুষই তিলকাকে নিজেদের মনে করেন আজও। আনুমানিক ১৭৫০ সাল নাগাদ বর্তমান বিহারের সুলতানগঞ্জ পরগণার তিলকপুরে তাঁর জন্ম। শৈশব থেকেই দেখে আসছেন কৃষি অর্থনীতি বদলাচ্ছে। বাংলার নবাবদের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাচ্ছে ব্রিটিশদের হাতে। শোষণ দেশীয় জমিদারদের হাতেও ছিল। কিন্তু বিদেশিদের হাতে পড়ে তার মাত্রা যেন অসহ্য হয়ে উঠতে থাকল। আর এর মধ্যেই এসে পড়ল ১৭৭০ সাল। হ্যাঁ, ভয়ঙ্কর ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। সারা বাংলা উজাড় হয়ে গিয়েছিল সেই দুর্ভিক্ষে। আর সাঁওতাল পরগণা ও জঙ্গলমহলে তার প্রভাব পড়েছিল আরও মারাত্মক। ঠিক এরকম সময়ে মানুষ আসা করেছিল, বাড়তি সাহায্য না পেলেও কোম্পানি নিশ্চই খাজনা মকুব করবে। অথচ বাস্তবে ঘটল সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা। ব্রিটিশ সরকার খাজনার পরিমাণ বাড়িয়ে দিল।
মানুষ হয়তো মুখ বুজেই মেনে নিত। সারা বাংলার মানুষ তো তাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু তিলকা মাঝির নেতৃত্বে জোট বাঁধল পাহাড়িয়া জনজাতি। ভাগলপুরে আছে কোম্পানির তোসাখানা। জঙ্গলমহল লুঠ করে সমস্ত অর্থ সংগ্রহ করা হয় সেখানে। তিলকা মাঝি একদিন কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হাজির হলেন সেখানে। অস্ত্র বলতে সঙ্গে ছিল কিছু তীর-ধনুক। কিন্তু আদিবাসীদের সেই প্রাচীন অস্ত্রের সামনেই হার স্বীকার করল ব্রিটিশ কর্মচারীদের বন্দুক-পিস্তল। তোসাখানার অর্থ চুরি করে সমস্ত সাঁওতাল ও পাহাড়িয়া মানুষদের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করে দিলেন তিলকা মাঝি। পুলিশের খাতায় সেদিনই না উঠেছিল দুর্ধর্ষ ডাকাত হিসাবে। আর আদিবাসী মানুষদের কাছে তিলকাই নেতা।
তিলকা মাঝির নেতৃত্বে আদিবাসী বিদ্রোহের তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকল। আর তাকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ পুলিশও জোর কদমে লেগে পড়েছে। জঙ্গলমহলের পরগণায় পরগণায় তৈরি হতে শুরু করল সেনা ছাউনি। তিলকার সন্ধান পেলেন না কেউই। কিন্তু অসহায় আদিবাসীদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার শুরু হল। তবু অত্যাচারের মুখেও কেউ তিলকাকে ধরিয়ে দিলেন না। কিন্তু নিজে বেঁচে থাকার জন্য স্বজাতির উপর এমন অত্যাচার কি মেনে নিতে পারেন তিলকা? ঠিক করলেন তিনি নিজেই ব্রিটিশ সেনাদের মোকাবিলা করবেন। যুবকদের নিয়ে তৈরি হল বাহিনী। এবারে সৈনিকদের হাতে আরও উন্নত অস্ত্র। কিন্তু আদিবাসীদের সেই তীর-ধনুকই ভীষণ রাগে ঝাঁপিয়ে পড়ল যুদ্ধক্ষেত্রে। ১৭৭৮ সাল, রামগড় ক্যান্টনমেন্টের সেই যুদ্ধে পরাস্ত হল ব্রিটিশ বাহিনী। আর তার পরেই দায়িত্ব নিয়ে এলেন অগস্ট ক্লিভল্যান্ড।
ক্লিভল্যান্ডের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিলেন তিলকা। আর তাই নানা প্রলোভন সত্ত্বেও তিনি ফাঁদে পা দিলেন না। এভাবে তিলকাকে ধরা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে সরাসরি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন ক্লিভল্যান্ডও। যে আদিবাসীরা এতদিন তাঁকে নিজেদের মানুষ হিসাবেই গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা অবাক হলেন। কিন্তু তিলকার হাত ছাড়লেন না। ১৭৮৪ সালে ঘটে গেল ভাগলপুরের রক্তক্ষয়ী লড়াই। বহু গোড়া পল্টন মারা গেলেন, মৃত্যু হল অসংখ্য আদিবাসীরও। তিলকার তীরে মৃত্যু হল ক্লিভল্যান্ডের। তাঁর অত্যাধুনিক রাইফেল কোনো কাজেই এল না। ক্লিভল্যান্ডের মৃত্যুর পর টনক নড়ল ব্রিটিশ প্রশাসনের। তাঁরা বুঝতে পারলেন এত সহজে আদিবাসীদের শায়েস্তা করা সম্ভব নয়। লেফট্যানেন্ট জেনারেল আয়ার ক্রুটকে দায়িত্ব দেওয়া হল নির্বিচারে সমস্ত আদিবাসীদের হত্যা করে বা বলপ্রয়োগ করে বিদ্রোহ দমন করতে। প্রায় তিনমাস ধরে চলল প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ। কেউ কাউকে জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি নয়। কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে গেল এক অঘটন। ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচারের মুখে এক পাহাড়িয়া তিলকার ঠিকানা জানিয়ে দিলেন। তাঁর নাম অবশ্য পুলিশের খাতা থেকে জানা যায় না। অতর্কিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিলকা। নিরস্ত্র অবস্থাতেই তিনি ধরা পড়লেন।
না, কোনো বিচার নয়। শুরু হল শাস্তি। পাঁচটা ঘোড়ার পিছনে বেঁধে সুলতানগঞ্জ থেকে ভাগলপুর পর্যন্ত টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হল তিলকা মাঝিকে। পাথুরে রাস্তায় ঘষে প্রথমে পোশাক ছিঁড়ল। তারপর চামড়া। সারা শরীর রক্তে লাল হয়ে উঠল। কিন্তু তারপরেও ভাগলপুর যখন পৌঁছলেন, তখনও তিলকা জীবিত। নিজের পায়ে উঠেও দাঁড়ালেন। আবার শুরু হল অত্যাচার। সারা রাত পুলিশের মার খেয়ে পরদিন সকালেই মারা গেলেন তিলকা। শেষ হল ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের প্রথম ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। মহাবিদ্রোহের ৮ দশক আগেই ঘটে গিয়েছিল মাঝি বিদ্রোহ। না, সাফল্য পায়নি। কিন্তু এই বিদ্রোহই তো পরে কোল বিদ্রোহ এবং সাঁওতাল বিদ্রোহের ভিত তৈরি করে দিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারকে বুঝতে শিখিয়েছিল, ভারতবর্ষ অতটা সহজ নয়। তবু পাঠ্য ইতিহাসে যেন আজও অবহেলিত তিলকা মাঝির কাহিনি।
আরও পড়ুন
ব্রিটিশ কলকাতায় নববর্ষ উদযাপন, সমুদ্র পেরিয়ে হাজির ইতালির গায়িকা!
Powered by Froala Editor