অনেকের নজরে শকুন (Vulture) অপয়া। অথচ শকুন এমন একটা পাখি, সংখ্যার দিক থেকে যার পতন হয়েছে সবচেয়ে দ্রুত। তিব্বতিরা শকুনকে চেনে ‘ডাকিনিস’ নামে। তিব্বতীয় মত অনুসারে, এই ডাকিনিসই দেবদূত। বিস্তৃত অর্থে ডাকিনিস আকাশের নৃত্যশিল্পী। তাঁরাই আত্মাকে স্বর্গের এমন এক স্থানে নিয়ে যান, যেখানে তা সুরক্ষিত থাকে পুনর্জন্মের আগে পর্যন্ত। শকুনকে মৃতদেহ খণ্ড করে কেটে খেতে দেওয়াকে পুণ্য মনে করা হয়। মৃতদেহকে মৃত্যুর পর তিনদিন কেউই স্পর্শ করেন না। এমনই রীতি।
তাছাড়াও এই সময় বৌদ্ধ ভিক্ষুকদেরও অন্যরকমের ভূমিকা থাকে। তাঁরা মৃতদেহের চারপাশে ঘোরেন। দ্বিমুখী ঢোল পেটান। জপ করেন। তাঁদের মুখে থাকে ধর্মীয় বাণী। আত্মা যেন ধর্মের ‘লোরি’ শোনে। মা যেমন তাঁর সন্তানকে লোরি শুনিয়ে ঘুম পাড়ান, এটা তেমন না হলেও এই প্রথায় রয়েছে মায়ের গন্ধ— ভ্রূণের আকার— মৃত্যুর প্রথা হলেও যা জন্মবাদেরই দ্যোতক।
কেন এমন বলা? আসলে আমরা যদি আকাশ সমাধির প্রাচীন প্রথার দিকে তাকাই, দেখব, পরিষ্কার করা হচ্ছে মৃতদেহকে। এরপর তা সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সাদা কাপড়ে মোড়ানো সেই মৃতদেহকে এমনভাবে রাখা হচ্ছে যে, মনে হবে মাতৃগর্ভে ভ্রূণ শোয়ানো। পরেরদিন ভোর হতেই শুরু হয়ে যায় শেষকৃত্যানুষ্ঠান। নেতৃত্বে থাকেন বৌদ্ধ লামারা। এর আগে অবশ্য মৃতদেহের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়, যাতে তা ভাঁজ করে আকাশ সমাধিস্থলে নিয়ে যাওয়া যায়। মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা এই যাত্রার অংশ নিতে পারেন। এই সময়েও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা উচ্চারণ করেন ধর্মীয় বাণী। সেই উচ্চারণের মাধ্যমে পথ দেখে আত্মা।
গীতার একটি শ্লোকের কথা মনে পড়ছে। নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাপি নৈনং দহতি পাবকঃ।/ ন চেনং ক্লেদয়ভ্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।। (গীতা ২/২৩) অর্থাৎ, আত্মাকে অস্ত্র দিয়ে কাটা যায় না, আগুনে পোড়ানো যায় না, জলে ভেজানো যায় না, অথবা হাওয়াতে শুকানোও যায় না। সনাতন ধর্মের এই ব্যাখ্যার আঁচ পাই তিব্বতিদের সমাধি প্রথার ব্যাখ্যা পাঠ করলেও। ক্ষেত্র আলাদা। পদ্ধতি আলাদা। কিন্তু সারমর্মে যেন কিছুটা মিলও রয়েছে।
আরও পড়ুন
বিলুপ্তপ্রায় শকুন সংরক্ষণে নয়া সাফল্য ভারতের পরিবেশবিদদের
যাই হোক, শেষকৃত্যানুষ্ঠান যে জায়গায় হবে, সেখানে মৃতদেহ জড়ানো সাদা কাপড়টিকে খুলে দেওয়া হয়। এরপর সেই মৃতদেহকে পিছনের দিক থেকে কেটে ফেলা হয় কুঠার ও কাটারি দিয়ে। এখানেই শেষ নয়, টুকরো টুকরো করে মৃতদেহটিকে কাটা হয়। হাড়গোড় করা হয় চূর্ণ। দেহের কাটা অংশগুলি ছড়িয়ে দেওয়া হয় শকুনদের খাদ্য হিসাবে। তবে হ্যাঁ, মৃতদেহ টুকরো করার আগে পর্যন্ত শকুনদের কিন্তু সমীপবর্তী হতে দেওয়া হয় না।
আরও পড়ুন
দু’দশকে ১১ গুণ সংখ্যাবৃদ্ধি, শকুন সংরক্ষণে লড়ছে মহারাষ্ট্রের গ্রাম
একটা প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, মৃতদেহের চূর্ণ হাড়গোড় কোথায় যায়? অবশিষ্ট হাড়গুলি একটি মণ্ডে ঢেলে দেওয়া হয়। যবের আটা, চা এবং গার্হস্থ্য ইয়াকের দুধ দিয়ে তৈরি ইয়াক মাখনের সঙ্গে মিশিয়ে পরে তা কাক এবং বাজপাখিকে দেওয়া হয়। সাধারণত, মৃতদেহ পরিবহণের জন্যও সাহায্য নেওয়া হয় চমরী গাই বা ইয়াকের। চিন সরকারের এহেন সমাধি প্রথা বিস্ময়কর বলে মনে হয়েছিল। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত এটি নিষিদ্ধ করেছিল তারা। তবে একটা সময় পর অতিব্বতিদের এই অনুষ্ঠান দেখার অনুমতি দেওয়া হয়, যদিও এই প্রথার ছবি তোলা অত্যন্ত ‘আপত্তিকর’। গোটা পদ্ধতি বেশ ব্যয়বহুল। যাঁরা এর খরচ বহন করতে পারেন না, তাঁদের জন্য মৃতদেহকে কেবল একটি উঁচু পাথরে রেখে আসা শ্রেষ্ঠ বিকল্প। আচারে অবদান রাখে ইউরেশিয়ান গ্রিফন ও হিমালয়ান গ্রিফন ।
বিশ্বাস, এরপর রোজাইপা (Rogyapa) শকুনবৃত্তের মধ্যে ঘুরে বেড়ান। তিনি মৃতদেহ প্রস্তুত করার দায়িত্বে নিয়োজিত একজন পবিত্র বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। দাফনের বিপরীতে এই আকাশ সমাধির স্থান। যা কোনো ইন্টার্নমেন্টে জড়িয়ে নেই। যা পশ্চিমি শোভাযাত্রার মতো নয়। এটি তিব্বত, কিংহাই, সিচুয়ান এবং অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়ার স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলে, একইসঙ্গে মঙ্গোলিয়া, ভুটান এবং ভারতের কিছু অংশ— যেমন সিকিম এবং জংশকারের মতো অঞ্চলে এখনও প্রচলিত। প্রস্তুতি এবং আকাশের সমাধিস্থানের স্থানগুলি বজ্রযান বৌদ্ধ ঐতিহ্য। এর নাম চার্নেল গ্রাউন্ড। যা জরোথুস্ট্রীয় সমাধি প্রথার অংশ, যেখানে মৃতদেহকে দাখমা নামক পাথরের কাঠামোর উপর শিকারের উপাদান এবং পাখির কাছে প্রকাশ করা হয়। মৃতদেহের শিরচ্ছেদ করার প্রাচীন রীতি থেকে তিব্বতের আকাশ সমাধিগুলি উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে করা হয়। বেশ কিছু সমাধিক্ষেত্র তিব্বতে রয়েছে। সেই সমাধিক্ষেত্রগুলি বিভিন্ন বৌদ্ধ মঠের সঙ্গে থাকে।
Powered by Froala Editor