প্রকৃতি-প্রাণ-বনভূমি নাকি 'উন্নয়ন', উত্তর খুঁজছে ঠুরগা জলবিদ্যুৎ স্টোরেজ প্রকল্পের ভবিষ্যত

মানুষের প্রতিদিনকার চাহিদা মেটাতে ক্রমশ বিপন্ন হচ্ছে বনভূমি। পৃথিবীর বুকের থেকে সবুজ ক্রমশ কমে আসছে। প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ নাকি তথাকথিত উন্নয়ন? এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের মধ্যে কোনদিকে ঝুঁকবে ভবিষ্যত? পৃথিবীর নানা প্রান্তে পরিবেশ আন্দোলনগুলি আসলে সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে চলেছে। আমাদের বাড়ির কাছে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের ঠুরগা নদীর ধারে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা আন্দোলন আবারও উস্কে দিয়ে যাচ্ছে এই প্রশ্নগুলিকে।

প্রায় দেড় দশক আগে পুরুলিয়া পাওয়ার স্টোরেজ প্রোজেক্ট (পিপাএসপি) তৈরি করার পর সেখানে দ্বিতীয় একটি প্রকল্পের প্রস্তুতি নেয় রাজ্য সরকার। জাপানের জিকা কোম্পানির সহায়তায় ২৫০ মেগাওয়াট করে চারটি ইউনিটে মোট ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংরক্ষণের উপযুক্ত একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়। কলকাতা শহরের জরুরি পরিস্থিতিতে এই সংরক্ষিত বিদ্যুৎ কাজে লাগানো যাবে। তবে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের অনুমোদন মিললেও এই প্রকল্পের ফলে বনের বাস্তুতন্ত্র অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে দাবি পরিবেশবিদদের। পাশাপাশি প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় আইনি অনুমোদন নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ।

ঠুরগা জলাধারের পাশেই রয়েছে হাতিনাদা, ভুঁইঘরা, শালডি, বাড়েলহর প্রভৃতি গ্রাম। গ্রামগুলিকে ঘিরে উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। প্রথমে গাছকাটার বিরোধিতা করে জেলাশাসক ও বিদ্যুৎ দপ্তরের কাছে চিঠি দেন ১৬৫ জন গ্রামবাসী। তারপর আইনমাফিক গ্রামসভার অনুমতি নেওয়া হয়নি, এই অভিযোগ তুলে আদালতে মামলা করেন রবি বেসরা সহ কয়েকজন গ্রামবাসী। গ্রামবাসীদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন সৌরভ প্রকৃতিবাদী, রাকেশ মুদলি সহ পরিবেশ আন্দোলনের একাধিক তরুণ মুখ।

গ্রামবাসীদের অভিযোগের ভিত্তিতে কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের বিচারপতি দেবাংশু বসাক প্রথমে প্রকল্পের উপর স্থগিতাদেশ দেন। তারপর গতবছর ২ জুলাই অন্তিম রায়ে তিনি জানান, প্রয়োজনীয় আইনি অনুমোদন নিয়ে তবেই প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে। এই রায়ের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হন রাজ্য সরকার। গত ২৪ জানুয়ারি ডিভিশন বেঞ্চে মামলার শুনানি শুরু হয়। বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, এইদিন সরকারপক্ষকে ভর্ৎসনা করে বিচারপতি সঞ্জীব ব্যানার্জি ও বিচারপতি কৌশিক চন্দ বলেন, মামলাটিকে সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন না। ১৪ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় দফার শুনানি ছিল। এরপর ২৪ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ম্যারাথন শুনানির পর অন্তিম রায় দেবে ডিভিশন বেঞ্চ।

একদিকে ২৩৪ একর জমির উপর বনভূমি, সবুজের সমারোহ। সেই বনভূমিকে ঘিরে নানান জীবজন্তুর বাস্তুতন্ত্র এবং জঙ্গলের উপর নির্ভর করে থাকা মানুষের জীবিকা। অন্যদিকে আধুনিক মানুষের ‘উন্নয়ন’। আদালতের রায় কোনদিকে যায়, সেদিকেই তাকিয়ে আছেন সবাই। যদি প্রকল্পের বিরুদ্ধে রায় দেন দুই বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ, তাহলে উন্নয়নের পরিবর্তে বন্যপ্রাণ রক্ষাই যে আজকে ভীষণভাবে প্রয়োজনীয়, এই কথাই প্রমাণ হবে। নাকি আদালত এই দুইয়ের ভিতর থেকে কোনো সমাধানসূত্র বের করতে পারবেন, যাতে পরিবেশের বড় কোনো ক্ষতি না করেও উন্নয়নের গতি এগিয়ে চলে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে ২৮ ফেব্রুয়ারির পর ডিভিশন বেঞ্চের অন্তিম রায়দান পর্যন্ত।