২০২০ সাল। দক্ষিণবঙ্গকে কার্যত তছনছ করে দিয়েছিল আমফানের তাণ্ডব। বাড়িঘর, কৃষিজমি থেকে শুরু করে আস্ত জনপদ— তিলে তিলে গড়ে তোলা মানব সভ্যতাকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলেছিল মুহূর্তের মধ্যে। দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণাবর্ত ‘মোচা’ নতুন করে ফিরিয়ে দিচ্ছে সেই আতঙ্ক। এখন থেকেই এই প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবিলা করতে আটঘাট বাঁধতে শুরু করেছে মানুষ। কিন্তু এই ঝড়ের প্রাবল্য প্রত্যক্ষ করতে যদি আপনাকে পাঠানো হয় ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে? অর্থাৎ যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় আই অফ দ্য সাইক্লোন (Eye Of The Cyclone)।
শুনতে খানিক আজগুবি লাগতে পারে বৈকি। তবে কিছু ঘূর্ণিঝড় ধাওয়া করে বেড়ানোই কিছু মানুষের পেশা। দু-একবার নয়, বরং বিমানের চেপে একাধিকবার প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র বা আই অফ দ্য সাইক্লোনকে অতিক্রম করেন তাঁরা। এই দুঃসাহসিক কাজের জন্য মোটা অঙ্কের বেতনও পান তাঁরা। কিন্তু কে দেয় এই বেতন? উত্তর, খোদ প্রশাসন। সরকার।
না, ভারতের কথা হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রে গেলে দেখা মিলবে এমনই এক আশ্চর্য বাহিনির। যাঁরা পরিচিত ‘হারিকেন হান্টার’ (Hurricane Hunters) নামে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘এয়ার ফোর্স রিজার্ভ’-এর ৫৩তম স্কোয়াড্রনের সেনারাই মূলত জড়িয়ে এই দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গে। তাছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ‘নোয়া’ অর্থাৎ ন্যাশনাল ওশিয়ানিক অ্যাটমোস্ফিরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনেরও রয়েছে বিশেষ বাহিনি। ঘুর্ণিঝড় তাড়া করতে মাঝেমধ্যে পাঠানো হয় মার্কিন নেভির সৈন্যদেরও। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন থেকে যায়, কেন ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে পাঠানো হয় তাঁদের? এমন বিপজ্জনক সিদ্ধান্তের কারণ কী?
না, কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য নয়। বরং, ঘূর্ণিঝড়ের প্রকৃতি এবং তার গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতেই এই বিশেষ দলকে পাঠানো হয় ঝড়ের মধ্যে। সঙ্গে থাকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এসব তথ্য কি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নেওয়া সম্ভব নয়?
আসলে এই রীতির সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৩ সালে। তখন বিশ্বযুদ্ধ চলছে পুরোদমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫৩তম স্কোয়াড্রনের এক বিমানচালক সহকর্মীদের সঙ্গে বাজি রেখে ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে বিমান ওড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। টেক্সাসের গ্যালভেস্টোন অঞ্চলের ওপর আছড়ে পড়ে একটি ক্যাটাগরি ১-এর হারিকেনকে বিমানে চেপে এফোঁড়-ওফোঁড় করেছিলেন তিনি। ফিরে এসে জানিয়েছিলেন তাঁর আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এমন দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের দ্বিতীয় নজির নেই কোনো। পরবর্তীতে ঝড়ের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার জন্য মার্কিন বিজ্ঞানীরা দ্বারস্থ হয়েছিলেন সরকারের। তাঁদের আবেদনই শেষ পর্যন্ত ৫৩ নম্বর স্কোয়াড্রনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ঘূর্ণিঝড় ধাওয়া করার জন্য। দীর্ঘদিন এভাবেই ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য সংগ্রহ করেছে মার্কিন গবেষকরা। পরবর্তীতে স্যাটেলাইটের সৌজন্য এই কাজ সহজ হয়ে গেলেও, কাজ হারাননি হারিকেন হান্টাররা। আজও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুকে ঘূর্ণিঝড় ঘনিয়ে এলেই ডাক পড়ে তাঁদের। সাধারণত, ভূপৃষ্ঠের ৫০০ ফুট ওপর থেকে ১০ হাজার ফুট উচ্চতা পর্যন্ত বিমানে চেপে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রকে একাধিকবার অতিক্রম করেন তাঁরা।
তবে মজার বিষয় হল, শুধু হারিকেন হান্টাররাই নন, বর্তমানে ঘূর্ণিঝড় তাড়া করে বেড়ান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু ফটোগ্রাফারও। এমনকি সাইক্লোনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে গড়ে উঠেছে ট্যুরিজমও। একাধিক সংস্থা বর্তমানে নেমেছে এই ব্যবসায়। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষরাও নেশায় নেশায় হাজির হন ঘূর্ণিঝড় দেখতে। এমনকি বর্তমানে ভারতের মধ্যেও বর্তমানে ধীরে ধীড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে স্ট্রম চেজিং। কী ভাবছেন? আসছে সাইক্লোনে স্ট্রম চেজারদের সঙ্গে দল বেঁধে নেমে পড়বেন মাঠে? ঝড়ের কাছে রেখে আসবেন নিজের ঠিকানা?
Powered by Froala Editor