জ্যোতিষ শ্রী ভৃগু, এই নাম নিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছেন কতজন তা বোধহয় গুনে শেষ করা যাবে না। প্রত্যেকেই আদি ও অকৃত্রিম। তিনি তো কোন ব্যক্তি নন, জ্যোতিষের জগতে শ্রী ভৃগু একটা প্রতিষ্ঠান।
'দুহাতে দুটো রিভলভার, বাঁ হাতে টর্চ' নিয়ে গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জি। আর এই বর্ণনাই গোগ্রাসে গিলছে বাঙালি পাঠক। সৌজন্যে লেখক শ্রী স্বপন কুমার।
'প্র্যাকটিস অফ মেডিসিন', 'টেক্সটবুক অফ প্যাথলজি', 'টেক্সটবুক অফ অ্যানাটমি' -- বইগুলোর বিক্রি আজও বছরে পাঁচ হাজারের কম নয়। লেখক ডা. এস এন রায়।
একটাই শরীরে নানা রূপ নিয়ে একটাই মানুষ বাজার মাত করে রেখেছেন। এছাড়া নামে-বেনামে লিখে গেছেন 'ডু ইট ইয়োরসেল্ফ' জঁরের অন্তত তিরিশটি বই। মানুষটিকে মনে রাখার জন্য বোধহয় এটুকুই যথেষ্ট। গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জির কাহিনির সাহিত্যমূল্য নিয়ে মাথা ঘামাননি কেউই। রঙচঙে কভারে পাতলা পাতার চটি বই, অনায়াসে লুকিয়ে ফেলা যায় পড়ার বইয়ের ফাঁকে। আর এভাবেই দূর মফঃস্বল পর্যন্ত কচিকাঁচাদের হাতে হাতে চলে যেত 'নিষিদ্ধ' এইসব কাহিনি। গোয়েন্দা গল্প মানে তো আমরা বুঝি কিশোরসাহিত্য। স্বপন কুমারের বইও কিশোর-কিশোরীরাই পড়ত। কিন্তু অভিভাবকদের লুকিয়ে। কারণ গল্পের পরতে পরতে থাকত নারীশরীর আর নিষিদ্ধ যৌনতার বর্ণনা। কখনও কখনও প্রচ্ছদেও আঁকা থাকত চটুল নারীশরীর। আর এইসব প্রচ্ছদ আঁকতেন নারায়ণ দেবনাথ, তুষার চ্যাটার্জী, শৈলেশ পালের মতো জনপ্রিয় শিল্পীরা।
তিনিই আবার জ্যোতিষ শ্রীভৃগু। নাড়ি জ্যোতিষ, সংখ্যা জ্যোতিষের মতো প্রাচীন পদ্ধতিগুলো শুধু পুনরুদ্ধারই করেননি, জনপ্রিয় করেছেন। জ্যোতিষ শ্রী ভৃগুর মতোই প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জিও। এপার বাংলায় কাহিনির ইতি ঘটলেও ওপারে এখনও তদন্ত করে যাচ্ছেন তিনি। দেব সাহিত্য কুটির, মহেশ পাবলিকেশন, আদিত্য -- এমনই অসংখ্য পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত কাহিনিগুলোর কোনটা আসল কোনটা নকল কিছুই বোঝা যায় না। নামে-বেনামে তিনি যে আরো কত ধরনের বই লিখেছেন, তার হিসেব কোথায় কারোর পক্ষেই রাখা সম্ভব নয়।
কপিরাইটের পরোয়া না করে কেন এমন অক্লান্ত লিখে গেছেন তিনি? সেকথা জানতে গেলে তাঁর জীবনের কাহিনি খানিকটা জানতেই হবে। রাজশাহীতে জন্মেছিলেন সমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডে। তারপর চোদ্দোবছর বয়সে চলে আসেন কলকাতা। এর কিছুকাল পর ভর্তি হন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে। আর তখনই তাঁকে বাড়ি থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, কলকাতায় থেকে পড়াশুনার খরচ পাঠানো সম্ভব নয়। টাকার প্রয়োজনেই হাত দেন দীপক চ্যাটার্জির কাহিনি তৈরিতে। 'প্রত্যেকখানির দাম চল্লিশ পয়সা' সিরিজে প্রকাশিত হতে থাকে এইসব কাহিনি। আর অচিরেই জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠে। কিন্তু তবুও একদিন প্রকাশকের ঘরে অপেক্ষা করে থাকতে হয়, কারণ গোয়েন্দা গল্প তো সবাই লিখতে পারে। জ্যোতিষের বইয়ের চাহিদা অনেক বেশি। সেই বেশি চাহিদার বাজারও মাত করেছিলেন তিনি। আর স্বনামে লিখে গেছেন চিকিৎসা শাস্ত্রের বই। বাজারে সব বইই জনপ্রিয়। অথচ সাহিত্যিকের জাতে উঠতে পারেননি তিনি। তাঁর লেখার সাহিত্যমূল্য হিসেব করতে বসবেন না কেউই। আত্মীয়রা জানান, সেই কষ্ট তিনি সবসময় অনুভব করে গেছেন। প্রকাশিত হয়েছে 'স্বপন কুমার সমগ্র'এর প্রথম খণ্ড। আক্ষেপের বিষয়, এই কাজ দেখে যেতে পারলেন না কিংবদন্তি এই মানুষটি। তবে বাঙালি পাঠকমনকে বুঝতে গেলে তাঁর কাহিনিকে বুঝতেই হবে।
তথ্যঋণ – দীপক রতন এবং স্বপনকুমার, শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় - আনন্দবাজার পত্রিকা
জ্যোতিষী স্বপনকুমার (শ্রীভৃগু) এমবিবিএস – এই সময়
স্বপন কুমার, ২০ টি গোয়েন্দা উপন্যাস, দেব সাহিত্য কুটির
Powered by Froala Editor