প্রাচীরে ঘেরা প্রকাণ্ড এক বাড়ি। প্রাসাদ বললেও ভুল হবে না তাকে। বয়সের দাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তার সারা শরীরে। সেইসঙ্গে অবহেলার ছাপ। গেটে ঝুলছে কয়েক দশক পুরনো জং ধরা লোহার তালা। তথৈবচ অবস্থা ভেতরের ঘরগুলিরও। কোথাও বিনাপরিচর্যায় গজিয়ে উঠেছে গাছ-গাছালি, মস, ফার্নের ঝাঁক। আবার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আসবাবপত্রের মধ্যে বাসা বেঁধেছে ছোট্ট পাখি। আর এসবের মাঝেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিন তরুণ যুবক। হাতে ক্যামেরা এবং নোটপ্যাড। প্রতিটা ঘর ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছেন তাঁরা। দেরাজ, আলমারি খুলে বের করে আনছেন উইপোকায় কেটে দেওয়া ডায়েরি কিংবা ঘুন ধরা ফটোফ্রেম। তারপর তা উল্টেপাল্টে দেখে আবার সযত্নে তা রেখে দিয়েছেন আগের মতোই।
এই দৃশ্য স্কটল্যান্ডের (Scotland) গ্লাসগো (Glasgow) শহরের। প্রাচীনত্বের দিক থেকে প্যারিস কিংবা লন্ডনের মতোই ঐতিহ্যবাহী গ্লাসগো শহর। তবে আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গেই রূপবদল হয়েছে তার। ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়েছে পুরনো প্রাসাদসম বাড়ি, চার্চ, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজগুলি। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ফ্ল্যাটবাড়ির চল। আর সেইসব ঐতিহ্যবাহী বাড়িরা? এখন তাদের ভগ্নদশা। পরিত্যক্ত অবস্থায় সময়ের স্মৃতিচিহ্ন হিসাবেই টিকে আছে তারা। অথচ, তাদের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, অজস্র মানুষের সুখ-দুঃখের স্মৃতি, প্রাচীন স্থাপত্য কারুকলা, ভাস্কর্যের নিদর্শনও।
না, এইসকল ঐতিহাসিক বাড়িগুলির সংস্করণ কিংবা সংরক্ষণ— কোনোটারই উদ্যোগ নেয়নি স্কটিশ প্রশাসন। উদাসীন বাড়ির মালিকরাও। বদলে এই দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরের দ্য থ্রি মাস্কেটিয়ার্স— অ্যালিস্টার, অ্যালেক্স এবং থিও। ‘আরবান এক্সপ্লোরার’ (Urban Explorers) হিসাবেই যাঁরা পরিচয় দেন নিজেদের। এই তিন তরুণ বন্ধুই নিজেদের সামান্য সামর্থে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন এইসব ঐতিহাসিক ভবনের। অবশ্য সংরক্ষণ বলতে পুনর্নির্মাণ নয়, ডকুমেন্টেশন। গ্লাসগো ও স্কটল্যান্ডের অন্যান্য শহরগুলিতে ঘুরে ঘুরে তাঁদের এই ছোট্ট দল তথ্য সংগ্রহ করছেন পরিত্যক্ত বাড়িগুলির। হারিয়ে যাওয়া গল্পদের খুঁজে বার করেই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। আর হাতিয়ার বলতে ক্যামেরা এবং নোটপ্যাড।
ইতিমধ্যেই এই ধরনের অসংখ্য বাড়ির ছবি ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করেছেন স্কটল্যান্ডের এই তিন তরুণ যুবক। তৈরি করে ফেলেছেন এক ডিজিটাল লাইব্রেরি। যেখানে উঁকি দিলেই ঘুরে আসা যাবে প্রাচীন এই ভবনগুলির ভেতরে। তাঁদের মতে, নগরায়নের জেরে আর হয়তো কয়েক দশকের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে এইসকল ঐতিহাসিক ভবনগুলি। তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের এককালীন অস্তিত্বের কথা তুলে ধরতেই এই উদ্যোগ তাঁদের।
অবশ্য বিপদও কম নেই এই কাজে। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে, তাঁদের উপর চাপতে পারে অনুপ্রবেশের শাস্তি। যদিও এখনও পর্যন্ত সেই ধরনের কোনো ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়নি গ্লাসগোর থ্রি মাস্কেটিয়ার্সকে। কেবলমাত্র কয়েকবার সংশ্লিষ্ট ভবনগুলির পাড়া-প্রতিবেশী ও স্থানীয় মানুষরা আপত্তি তুলেছিলেন। তাঁদের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে কাজ হয় শেষ পর্যন্ত। বলার অপেক্ষা থাকে না, স্কটিশ যুবকদের এই উদ্যোগ সত্যিই অভূতপূর্ব। কলকাতার বুকেও যে টিমটিম করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রয়েছে এমনই অজস্র বাড়ি। যাদের বর্ণময় ইতিহাস আজ ম্লান হয়ে গেছে আধুনিকতার আগ্রাসনে। আদৌ কি তাদের গল্প সংরক্ষিত হবে অদূর ভবিষ্যতে? জানা নেই…
Powered by Froala Editor