প্রয়াত তিনবারের জাতীয় পুরস্কারজয়ী অভিনেত্রী সুরেখা সিক্রি

শিল্পীর জীবন যেন সাদা ক্যানভাস – মনে করতেন তিনি। তার মধ্যে প্রতি মুহূর্তে রঙের খেলা চলে। কিন্তু কখন সেই ক্যানভাসের সমস্ত শূন্যস্থান ফুরিয়ে যায়, তা যেন আগে থেকে টের পাওয়া যায় না। এভাবে হঠাৎই অভিনয়ের জগতকে পিছনে ফেলে বিদায় নিলেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুরেখা সিক্রি। শুক্রবার সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হল তাঁর।

ভারতের টিভি অপেরার কথা বললে হয়তো সবার আগেই যে ধারাবাহিকের নাম দর্শকদের মনে আসবে, সেটা ‘বালিকা বধূ’। আর এই ধারাবাহিকে দাদিশাহ চরিত্রটিতে মুগ্ধ হননি, এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া যাবে না। চরম নেতিবাচক চরিত্রেও কীভাবে দর্শকদের মন জয় করে নেওয়া যায়, তা যেন শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন সুরেখা। অবশ্য সারা জীবনে কঠিন চরিত্রে অভিনয় তো তাঁর কাছে নতুন নয়। ১৯৭৮ সালে ‘কিসসা কুর্সি কা’ থেকে রুপোলি পর্দায় যাত্রা শুরু। আর তার আগে নাট্যমঞ্চের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তো রয়েছেই।

১৯৪৫ সালে আলমোড়া শহরে জন্ম সুরেখা সিক্রির। বাবা ছিলেন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন বায়ুসেনা। আর মা শিক্ষিকা। তবে ছোটো থেকে কখনও অভিনয়কে পেশা করার কথা ভাবেননি সুরেখা। সেই ইচ্ছা জন্ম নিল আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে ভর্তি হলেন দিল্লির ‘ন্যাশানাল স্কুল অফ ড্রামা’-তে। দুবছর সেখানে শিক্ষাগ্রহণের পর প্রতিষ্ঠানের তথ্যভাণ্ডারের কাজে যোগ দিলেন। আর সেইসঙ্গে চলল দিল্লির রঙ্গমঞ্চে দাপুটে অভিনয়। পরে অনেকবার তিনি বলেছেন, ঠিক কোন ধরণের চরিত্রে তিনি মানানসই, তা বুঝতে পারতেন না। নিজের অভিনয় নিয়ে কখনও সন্তুষ্টিও আসেনি। শুধু আরও বেশি বেশি অভিনয় করে যাওয়ার খিদে তাঁকে তাড়া করত। আর তাই কোনো চরিত্রকেই ফিরিয়ে দিতেন না তিনি।

ঠিক এই সময়েই ‘কিসসা কুর্সি কা’ ছবির দ্বিতীয় প্রযোজনায় অভিনয়ের সুযোগ পান সুরেখা। দেশের জরুরি অবস্থার প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে তৈরি এই সিনেমার প্রথম প্রযোজনা বে-আইনি ঘোষণা করা হয়েছিল। নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল সমস্ত রিল। ১৯৭৮ সালে সেই নিষিদ্ধ ছবিই আবার নির্মিত হল। আর সেখানেই নিজেকে মেলে ধরলেন সুরেখা। কাজটা সহজ ছিল না। প্রথম প্রযোজনাটি মাত্র একবার দেখেছিলেন তিনি। সেই স্মৃতিটুকু সম্বল করেই তাকে আবার নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু এই কঠিন পরীক্ষাতেও সফলভাবে উত্তীর্ণ হলেন সুরেখা। আর তারপর দিল্লি ছেড়ে মুম্বাইতেই স্থায়ীভাবে কাজ শুরু করলেন তিনি। মঞ্চাভিনয় ছেড়ে এবার রূপালি পর্দাতেই শুরু হল জয়যাত্রা।

আরও পড়ুন
চলচ্চিত্রে প্রথম ও শেষ অভিনয় সৌমিত্রের সঙ্গে, সাত মাসের ব্যবধানে প্রয়াত স্বাতীলেখাও

খ্যাতি এবং প্রসংশার জন্য কখনও পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি সুরেখাকে। তিনবার জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। তামাস (১৯৮৮) এবং মম্মো (১৯৯৫) ছবিতে তাঁর অভিনয় সমস্ত সমালোচককে মুগ্ধ করেছে। ধীরে ধীরে বলিউডে স্নেহশীলা ও বুদ্ধিমতী মায়ের চরিত্রের সমার্থক হয়ে উঠেছিলেন সুরেখা। আবার সেই স্টিরিওটাইপ ভেঙে ‘বালিকা বধূ’-তে হাজির হলেন একেবারে নেতিবাচক চরিত্রে। এরপর অবশ্য বেশ কিছুদিন অভিনয়ের সুযোগ পাননি তিনি। ধীরে ধীরে শরীরও ভেঙে পড়ছিল। প্রায় ২ বছরের বিরতির পর আবার তাঁকে দেখা গেল অমিত শর্মার ‘বধাই হো’ (২০১৮) ছবিতে। আবারও জাতীয় পুরস্কারের সম্মান পেলেন তিনি। কিন্তু এর মধ্যেই সেরিব্রাল স্ট্রোকের পর শারীরিকভাবে ভেঙে পড়লেন একেবারে।

আরও পড়ুন
আবার ঘাতক কোভিড, প্রয়াত শঙ্খ ঘোষের স্ত্রী প্রতিমা ঘোষ

একসময় চিকিৎসার খরচটুকুও জোগাড় করতে পারছিলেন না সুরেখা সিক্রি। অথচ কখনও কারোর কাছে সাহায্য চাননি। শুধু অসুস্থ শরীরেও পর্দায় ফিরতে চেয়েছেন বারবার। আর একবার তাঁকে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন পরিচালকদের কাছে। এই সময় অবশ্য সোনু সুদ সহ বলিউডের অনেক তারকাকেই পাশে পেয়েছেন তিনি। গতবছর নেটফ্লিক্সের ভৌতিক সিরিজ ‘ঘোস্ট স্টোরিজ’-এ আবারও জোয়া আখতারের পরিচালনায় ফিরে এলেন সুরেখা। এবার তিনি এক পক্ষাঘাতগ্রস্ত অসহায় মায়ের ভূমিকায়। আবারও দর্শকদের মন জয় করলেন সুরেখা। কিন্তু এই বিপুল সাফল্যের পরেই সেপ্টেম্বর মাসে আবারও সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হন তিনি। দীর্ঘ চিকিৎসার পরেও ব্যর্থ হল লড়াই। ১৬ জুলাই সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে চলে গেলেন কিংবদন্তি এই অভিনয়শিল্পী। রেখে গেলেন ৭৫ বছরের জীবনের বর্ণময় রূপকথা।

আরও পড়ুন
মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতেই প্রয়াত শিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশী

Powered by Froala Editor