বদলাচ্ছে পাঠকের রুচি, ব্যাতিক্রমী বইয়ে নজর ব্রিটেনের তিন প্রকাশনা সংস্থার

অনেকেই বলেন, বইয়ের যুগ শেষ হয়ে আসছে। আজকের ব্যস্ত পৃথিবীতে বই পড়ার সময় কোথায় মানুষের? কিন্তু বাস্তবে ছবিটা কি আদৌ সেরকম? নাকি বইয়ের পাঠক ক্রমশ নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন? যে 'দেখবো এবার জগৎটাকে' ভাব নিয়ে বইয়ের বাজার শুরু হয়েছিল, তা কি আদৌ আছে? নাকি সমাজের একমুখী চলনে ধাক্কা খেতে খেতে বইয়ের ভাষাও হয়ে উঠেছে সেই 'স্বাভাবিক' চলনেরই অংশ?

বার্টন পাইকের কথায়, সেইসব কল্পকাহিনী সমস্ত পৃথিবী ছেয়ে ফেলছে, যার কোন উৎসমূল নেই। তাঁর মতে এগুলো কোনো সংস্কৃতি নয়, একধরনের বাণিজ্যিক প্রকরণ মাত্র। প্রায় একই কথা উঠে আসে লন্ডনের সাহিত্যিকদের সংগঠন 'স্প্রেড দ্য ওয়ার্ড'এর রিপোর্টে। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ব্রিটেনের বইয়ের বাজারে প্রতি বছর যেসব বই প্রকাশ পাচ্ছে, তার বেশিরভাগ অংশটাই সাদা চামড়ার মধ্যবিত্ত সাহিত্যিকের কলম থেকে। কালো চামড়ার সাহিত্যিকদের বই বাজারে আসছে বছরে ১০০টিরও কম। তার মধ্যে এক শতাংশ হয়তো লাভের মুখ দেখছে। অথচ আজকের সাহিত্যে খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে আসার কথা ছিল নারীর ভাষ্য, এলজিবিটিকিউ বর্গের মানুষের কথা, রাষ্ট্রহীন শিকড়হীন মানুষের বেঁচে থাকার কথা। কিন্তু বইয়ের বিপণন জগতের একবগগা কাহিনির ভিড়ে সেসব চাপা পড়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এই আকালেও স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাননি অনেকেই। পৃথিবীজুড়ে তাই উঠেও আসছে স্বীকৃতির আড়ালে থাকা নানারকম ভাষ্য। সেসব বইয়ের নিজস্ব বাজারও গড়ে উঠছে। এখনও হয়তো কুঁড়ি হয়েই আছে সেসব প্রচেষ্টা, কিন্তু ফুল হয়ে ফুটে ওঠার বিষয়ে আশাবাদী প্রত্যেকেই। গত দশকে ব্রিটেনে তৈরি হওয়া তিনটি ছোটো প্রকাশনা সংস্থা সেই অন্য স্বরগুলোকেই তুলে আনতে বদ্ধ পরিকর। ছোট সংস্থা হলেও ইতিমধ্যে কিন্তু বেশ বড়ো অংশের পাঠকের কাছেই পৌঁছে গেছে তারা। ভিন্ন স্বাদের সাহিত্যের সম্ভার নিয়েই এদের আত্মপ্রকাশ। সাহিত্যে বৈচিত্র্য নয়, বিচিত্র ধারার সাহিত্যের সমন্বয়ই উদ্দেশ্য, জানাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। একনজরে দেখে নেওয়া যাক এই তিন সংস্থার কাজ।

১) নাইটস অফ এবং রাউন্ড টেবিল বুক:

'নাইটস অফ' পাবলিকেশনের প্রতিষ্ঠা ২০১৭ সালে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ভিন্ন ধারার শিশুসাহিত্য প্রকাশ করা। এইমি ফেলন ও ডেভিড স্টিভেন্স এই উদ্যোগের শুরুতে বেশ আর্থিক সমস্যায় পড়েছিলেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি। একটি সমীক্ষায় তাঁরা দেখেছিলেন, ব্রিটেনের শিশুসাহিত্যের কাহিনির অধিকাংশই সাদা চামড়ার মধ্যবিত্ত শিশুদের কাহিনি। অনেক পাঠকই তার সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারেন না। শিশুমনের কল্পনায় যখন তারা কোনো কাহিনির মধ্যে নিজেদের খুঁজে পায় না, তখন নানা ধরনের অবসাদ তাদের গ্রাস করে। শিশুপাঠকদের জন্য যুগোপযোগী সাহিত্যকে উৎসাহ দিতে চেয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অনেকেই।

২০১৭-তে পথচলা শুরু করে একবছরের মধ্যেই ব্রিক্সটনে নিজস্ব বুক স্টল তৈরি করে ফেলেছেন তাঁরা। 'রাউন্ড টেবিল বুক' নামের সেই স্টল থেকেই চলে প্রকাশনার বেশিরভাগ কাজ। পাঠকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকায়, প্রকাশনার কাজ নিয়ে আরো বেশি ভাবনাচিন্তার অবকাশ পাচ্ছেন বলেই মনে করছেন এইমি ফেলন। ইতিমধ্যে ১০০-র উপর বই প্রকাশ করেছে 'নাইটস অফ'। তার মধ্যে যেমন আছে নানা ধরনের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি, তেমনই আছে কমিকস অথবা জ্ঞানবিজ্ঞানের বই। এইমি ফেলন মনে করেন, সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয় যখন বই হাতে নিয়ে শিশুপাঠকরা বলবে, এই চরিত্রটি ঠিক তার নিজের মতো।

২) ডায়ালগ বুকস :

২০১৫ সালে শারমিন লাভগ্রোভ এই প্রকাশনা সংস্থাটি তৈরি করেন। ছোট থেকেই রাজনৈতিক পরিবেশে বড় হয়েছেন লাভগ্রোভ। পরিচয় হয়েছে ষাটের দশকে সাড়া পৃথিবীজুড়ে যেসব ভিন্ন স্বাদের সাহিত্য রচনার উদ্যোগ চলেছিল, তার সঙ্গেও। কেরিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ না পাওয়া সেসব বই বিক্রিকেই। কিন্তু সেসব পুরনো বইতে তো সেই সময়ের ছবি উঠে এসেছে। আজকের পৃথিবীতেও তো নানা ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতার ভিতর দিয়ে যেতে হচ্ছে মানুষকে। নানা জায়গায় ক্ষয়িষ্ণু জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান, মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংকট যেমন আছে, তেমনি আছে উদ্বাস্তু সমস্যা, ভিন্ন যৌনতার মানুষের উপর নিগ্রহ, ধর্মীয় হিংসা, জাতি হিংসা - নানাকিছু। অথচ ব্রিটেনের মূল ধারার সাহিত্যে সেসব কথা উঠে আসে না বললেই চলে। লাভগ্রোভ চেয়েছেন সেইসব অবদমিত ভাষ্যগুলোকে তুলে আনতে। ক্ষমতার বিরুদ্ধে থাকা নানা প্রান্তঃস্বরকে পরস্পরের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিতে। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তৈরি 'ডায়ালগ বুকস'।

৩) গুড লিটারালি এজেন্সি :

সমাজের একমুখী চলনকে অস্বীকার করে যারা নিজেদের মতো বাঁচতে চান, তাঁদের কথা কতটুকু শুনতে অভ্যস্ত আমরা? ভিন্ন যৌনতা, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন ধর্মমতের মানুষদের চিরকাল 'অপর' বলে দাগিয়ে দিতেই তো অভ্যস্ত আমরা। তাদের কথা হয়তো লিটল ম্যাগাজিনে উঠে আসে, কিন্তু বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলো কি এগিয়ে আসে তাদের কথা বলতে? সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ২০১৫ তে সাহিত্যিক নিকেস সুক্লা এবং জুলিয়া কিংসফোর্ড তৈরি করেন 'গুড লিটারালি এজেন্সি'। এগিয়ে আসেন ব্রিটেনের বহু নামকরা সাহিত্যিক। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন জে কে রাউলিং। সংস্থার উপদেষ্টার পদে আছেন তিনি। নতুন এই প্রকাশনা সংস্থাকে উৎসাহ দিতেই এগিয়ে এসেছে 'পেঙ্গুইন পাবলিকেশন'। নতুন ধারার সাহিত্যিকদের উৎসাহ দিতে এই দুই প্রকাশনা সংস্থার উদ্যোগে তৈরি হয়েছে #মার্কি বুক টাইটেল। এগিয়ে এসেছেন লন্ডনের আর্টস কাউন্সিল।

দীর্ঘদিন ধরে স্বীকৃতির আড়ালে থাকা এইসব ভিন্নস্বর প্রকাশ পাচ্ছে ক্রমশ। শুধু ব্রিটেনেই নয়, পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রকাশনা সংস্থাগুলি এগিয়ে আসছে সেইসব সাহিত্যিকদের উৎসাহ দিতে। এবং সবচেয়ে বড়ো কথা, বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা নয়, বরং পরস্পরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলি। 'বইয়ের পাঠক নেই' এই মন খারাপ করা বক্তব্যের ঘেরাটোপে আর হয়তো বেশিদিন থাকতে হবে না। বরং পাঠকের কাছে তার রুচি অনুযায়ী বই এগিয়ে দেওয়ার কথাই ভাবছেন নতুন যুগের প্রকাশকরা।