ইউরোপজুড়ে ছাপা হত ‘বিষাক্ত বই’, দীর্ঘদিনের ব্যবহারে হতে পারে মৃত্যুও

‘মেইন ক্যাম্ফ’। হিটলারের এই আত্মজীবনকে ‘বিষাক্ত’ বলেই অভিহিত করেন বহু ঐতিহাসিক। তার কারণ এই গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে জাতিগত ঘৃণা এবং হিংসার বীজ। কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই কি কোনো বই ‘বিষাক্ত’ (Poisonous) হবে পারে? কোনো বই দীর্ঘদিন পড়লেই কি মৃত্যু হতে পারে মানুষের? 

অবাক লাগাই স্বাভাবিক। তবে উনিশ শতকের ইউরোপে ছাপা হাজার হাজার বই-ই বাস্তবেই বিষাক্ত। সেগুলি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করতে থাকলে রীতিমতো প্রাণ সংশয়ের সম্ভাবনা রয়েছে পাঠক বা ব্যবহারকারীরও। কিন্তু এমন আশ্চর্য ঘটনার কারণ কী? ভাবছেন হয়তো, কালোজাদু কিংবা ব্ল্যাক ম্যাজিকের কোনো বইয়ের কথা হচ্ছে। না, তেমনটা নয়। এর নেপথ্যে কারণ আসলে বিজ্ঞান। 

পরিবেশে প্রাপ্ত বিষাক্ত মৌলগুলির মধ্যে অন্যতম আর্সেনিক (Arsenic)। পানীয় জলের মাধ্যমে সামান্যতম এই বিষ দেহে প্রবেশ করলেও তৈরি হয় একাধিক শারীরিক জটিলতা। আর এই আর্সেনিকেই বিভিন্ন যৌগই বই বাঁধানোর সময় ব্যবহৃত হত উনিশ শতকের বিভিন্ন ছাপাখানায়। 

১৮১৪ সাল। জার্মানির শোয়ানফুর্ট শহরের বুকে সর্বপ্রথম তৈরি হয় সবুজ রঙের একটি বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ। নেপথ্যে উইলহেলম ডাই এবং হোয়াইট লিড কোম্পানি। মূলত রঞ্জক হিসাবে ব্যবহৃত হত এই পদার্থটি। তবে এই রঞ্জক যে বিষাক্ত সে-ব্যাপারে তৎকালীন সময়ে বিন্দুমাত্র সচেতন ছিলেন না জার্মানরা। নকল ফুল, ওয়াল পেপার, এমনকি বই বাঁধানোর কাপড়— সর্বত্রই রং হিসাবে ব্যবহৃত হত এই রাসায়নিক।

ইতিহাস ঘাঁটলে বোঝা যাবে, সতেরো ও আঠারো শতকে বই বাঁধানোর জন্য ব্যবহৃত হত মূলত চামড়াই। তবে উনিশ শতকের শুরু থেকেই ক্রমশ চামড়ার দাম এবং চাহিদা— দুই-ই বাড়তে থাকলে, বই বাঁধানোর জন্য বিকল্পের অনুসন্ধান শুরু করেন ইউরোপের বই ব্যবসায়ীরা। চামড়ার পরিবর্তে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সবুজ রঞ্জকে রাঙানো কাপড়ের মোড়ক। জার্মানি টো বটেই, এই বাঁধাই প্রক্রিয়া রীতিমতো প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে গোটা ইউরোপেই। 

এরপর রাইনের বুক দিয়ে বয়ে গেছে বহু জল। একুশ শতকের শুরুতে ডেলাওয়্যারের উইন্টারথর মিউজিয়ামে এই বিশেষ সবুজাভ রঞ্জক দৃষ্টি আকর্ষণ করে গবেষক মেলিসা টেডোনের। ব্যক্তিগত আগ্রহেই এই রঞ্জক নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন তিনি। আর সেখান থেকেই উঠে আসে ভয়ঙ্কর তথ্য। প্যারিস গ্রিন, ভিয়েনা গ্রিস বা শোয়ানফুর্ট গ্রিন রঙের মোড়কে আদতে লুকিয়ে রয়েছে আর্সেনিকের একটি বিশেষ যৌগ— আর্সেনিক ট্রাইঅক্সাইড। সেইসঙ্গে সেখানে উপস্থিত আরেক বিষাক্ত যৌগ কপার অ্যাসিটেট এবং সীসা, ক্রোমিয়াম, পারদের মতো ভারি ধাতু। 

মেলিসার কথায় আর্সেনিক ট্রাইঅক্সাইডের কারণে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ভয়ঙ্কর ক্ষতি, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাছাড়াও এই যৌগ ন্যূনতম মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করলে দেখা দিতে পারে ক্লান্তি, হাতে-পায়ে বাত, ডায়রিয়ার মতো অসুখ। এমনকি তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উঠে আসে, মানুষের প্রাণ নেওয়ার জন্য আর্সেনিকের যে ডোজ প্রয়োজন, তার ১.৪ শতাংশ ডোজের সমপরিমাণ আর্সেনিক উপস্থিত এই ধরনের গ্রন্থে। ফলে, ব্যবহারকারীর অজান্তেই তা ক্রমাগত শরীরে প্রবেশ করেছে সেই ডোজ। হয়তো অনেকক্ষেত্রে মানুষকে প্রাণও দিতে হয়েছে এইধরনের বইয়ের জন্য। মেলিসার ধারণা, উনিশ শতকের শেষলগ্নে ইউরোপীয় বুঝতে পেরেছিল আদতে এই যৌগটি ক্ষতিকর। সেই কারণেই হয়তো, আকস্মিকভাবে ব্যবহার বন্ধ হয়েছিল আর্সেনিকযুক্ত সবুজ রং-এর। যদিও এ-ব্যাপারে কোনো লিখিত তথ্য বা নথি আবিষ্কৃত হয়নি আজ পর্যন্ত।  

চাঞ্চল্যকর এই আবিষ্কারের পরই ‘পয়জনাস বুক প্রোজেক্ট’ নামে একটি বিশেষ উদ্যোগ নেন গবেষক মেলিসা টোডেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থশালা এবং মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আর্সেনিক-যুক্ত মলাট বিশিষ্ট বইগুলিকে চিহ্নিত করার জন্যই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর কথায়, আজ সাধারণ মানুষ নয়, বরং এই বইগুলির সংস্পর্শে আসেন মূলত গবেষক, লাইব্রেরিয়ান এবং অ্যান্টিক অনুসন্ধানী মানুষ। তাঁদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলাই প্রধান উদ্দেশ্য মেলিসার। 

Powered by Froala Editor

Latest News See More