দক্ষিণ ইউক্রেনের ওডেসা ওবলাস্ট প্রদেশে অবস্থিত টুজলি ন্যাশনাল পার্ক। একদিকে ছোট্ট দেশ মলডোভা, অন্যদিকে কৃষ্ণসাগর। ইউক্রেনে এই জাতীয় উদ্যানে প্রতিবছর হাজির হতেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েকশো জীববিজ্ঞানী। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ (Russia-Ukraine Conflict) শুরু হওয়ার পরই বন্ধ হয়েছিল গবেষকদের আনাগোনা। আর এখন এই সংরক্ষিত অরণ্য সম্পূর্ণভাবেই পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। সমুদ্রতটে গেলেই চোখে পড়বে কোনো-না-কোনো মৃতদেহ।
না, মানুষের নয়। সামুদ্রিক প্রাণীদের (Marine Animals)। গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকেই প্রাণ হারাচ্ছে অগণিত সামুদ্রিক প্রাণী। এ-কথা স্বয়ং জানাচ্ছেন টুজলি ন্যাশনাল পার্কের প্রধান গবেষক ইভান রুসেভ। টুজলির কর্মচারীদের একাংশ যুদ্ধের কারণে কাজ ছাড়লেও, এই অভয়ারণ্যকেই আঁকড়ে রয়েছেন ইভান। গুটিকয়েক সহকর্মী নিয়েই প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছেন সমীক্ষা। আর তাতেই উঠে আসছে ভয়াবহ তথ্য।
গত মে মাস থেকে এখনও পর্যন্ত সবমিলিয়ে ২৫০০টি ডলফিন এবং পরপয়েসের মৃতদেহ চিহ্নিত করেছেন রুসেভ। যেগুলি ভেসে এসেছিল টুজলির ৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রতটে। তবে এখানেই শেষ নয়। টুজলি ছাড়াও কৃষ্ণসাগর সংলগ্ন অঞ্চলে ইউক্রেনের একাধিক জাতীয় উদ্যান রয়েছে। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি বর্তমানে রুশ সেনাবাহিনীর আওতায়। তাছাড়া কিছু কিছু জাতীয় উদ্যানের সীমান্তে গবেষকদের যাতায়াতও নিষিদ্ধ করেছে ইউক্রেনের সেনারা। সেখানেও যে ডলফিন ও অন্যান্য সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মৃতদেহ ভেসে আসছে না, সে-কথা বলা চলে কীভাবে? তাছাড়া বহু ডলফিনের মৃতদেহ সমুদ্রে তলিয়ে গেছে, সেই সম্ভাবনাও তো উড়িয়ে দেওয়া চলে না।
কাজেই এই পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করেই ইভানের অনুমান, বিগত এক বছরের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ সহস্রাধিক সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীর। কিন্তু রুশ-ইউক্রেন সংঘাতের কারণেই যে এইসকল ডলফিন প্রাণ হারিয়েছে, তার প্রমাণ কী?
রুসেভ জানাচ্ছেন, শুধু যুদ্ধের সময়ই নয়, তার বহু বছর আগে থেকেই প্রতিনিয়ত টুজলি পার্কের সমুদ্রতটে সমীক্ষা চালান গবেষকরা। সেক্ষেত্রে একটা গোটা বছরে সবমিলিয়ে ৮-১০টি ডলফিনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। সমুদ্র তীরবর্তী ইউক্রেনের অন্যান্য সমস্ত জাতীয় উদ্যানগুলির পরিসংখ্যান যোগ করলে সংখ্যাটা পৌঁছায় ১০০-র কাছে। ফলত, অস্বাভাবিক মাত্রায় ডলফিনের মৃত্যুর পরিসংখ্যান বেড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ যুদ্ধই।
তাছাড়া স্বাভাবিকভাবে ডলফিনের মৃত্যু হয়ে থাকে মাছ ধরার ট্রলার, জাহাজ কিংবা জালের সঙ্গে সংঘাতের ফলে। সেক্ষেত্রে ডলফিনের গায়ে আঘাতের চিহ্নও দেখতে পাওয়া যায়। তবে বিগত এক বছরে পাওয়া মৃতদেহগুলির ক্ষেত্রে অনুপস্থিত সেই ক্ষতদাগ। অর্থাৎ, স্পষ্টভাবেই তাদের মৃত্যু হয়েছে অন্য কারণে। কিন্তু কী সেই কারন?
রুসেভের কথায়, যুদ্ধের কারণে কৃষ্ণসাগরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে রাশিয়ার সাবমেরিন ও অন্যান্য যুদ্ধ জাহাজ। একইভাবে তাদের শনাক্ত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে ইউক্রেনও। ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে সামরিক গ্রেডের সোনারের ব্যবহার। আর এই ঘটনাই প্রভাবিত করছে ডলফিন ও অন্যান্য সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীদের। সাধারণ, ইকোলোকেশনের মাধ্যমেই গতিপথ নির্ধারণ করে এইধরনের প্রাণীরা। সোনারের ব্যবহারের ফলে সেই ক্ষমতা হারিয়েই প্রাণ দিতে হচ্ছে তাদের।
হ্যাঁ, রুসেভের এই তত্ত্ব প্রমাণিত হয়েছে এর আগেও। একাধিক যুদ্ধে ও যুদ্ধাভ্যাসে সাবমেরিন ও যুদ্ধজাহাজের ব্যবহারের কারণে প্রাণ হারিয়েছে ডলফিনরা। তবে পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ কতটা ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে সামুদ্রিক এই প্রাণীদের শরীরে— এবার তারই উদাহরণ হয়ে উঠল কৃষ্ণসাগর! ইতিমধ্যেই অতিবাহিত ১১ মাস। এখনও যুদ্ধ থামানোর নাম নেয়নি কোনো পক্ষই। ফলে সবমিলিয়ে কোথায় পৌঁছাবে এই পরিসংখ্যান, তা নিয়েই সন্দিগ্ধ গবেষকরা…
Powered by Froala Editor