উষ্ণায়নের ফলে হারাতে বসেছে ‘এমপেরর’-রা, মৃত্যুর মুখে কয়েক হাজার নবজাতক

আন্টার্কটিকা (Antarctica) মহাদেশের প্রাণীকূলের কথা উঠলেই, সবার আগে মাথায় আসে পেঙ্গুইনের ছবি। তার মধ্যে বৃহত্তম প্রজাতি ‘এমপেরর পেঙ্গুইন’ (Emperor Penguin)। উচ্চতায় প্রায় সাড়ে তিনফুট। কালো শরীর, পেটের অংশ সাদা হলেও রয়েছে কিঞ্চিৎ হলুদ আভা। কিন্তু বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বিপদের মুখে পড়েছে তাদের অস্তিত্ব। গত এক বছরে দক্ষিণ মেরুতে মারা গেছে কয়েক হাজার নতুন পেঙ্গুইন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বিলুপ্ত করে দিতে পারে প্রজাতিটিকে।

এমপেরর পেঙ্গুইন প্রতিবছর হাজার-হাজার কিলোমিটার সমুদ্র পার করে এসে আন্টার্কটিকার বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে তোলে কলোনি। সাধারণত মার্চ মাসে প্রজনন প্রক্রিয়া সম্পন্নের উদ্দেশ্যে দক্ষিণ মেরুতে এসে পৌঁছোয় তারা। সেপ্টেম্বর নাগাদ জন্ম নেয় নতুন পেঙ্গুইন। কয়েক মাসে নবজাতকদের বড়ো করে তুলে, প্রবল ঠাণ্ডার উপযুক্ত করে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে আবার সদলবলে ভেসে পড়ে সমুদ্রে।

কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরেই ক্রমশ বদলে যাচ্ছে চিত্রটি। এ বছরে যা ভয়ানক আকার নিয়েছে। উষ্ণায়নের জেরে ২০২২-এর নভেম্বর থেকেই দক্ষিণ মেরুতে বরফ গলতে শুরু করে। তখনও সমুদ্রে ভাসার মতো উপযুক্ত শরীর তৈরি হয়নি শিশু পেঙ্গুইনদের। ফলে হিমশীতল জলে ডুবে বা বরফের উপরেই মৃত্যু ঘটেছে ১০০০০ পেঙ্গুইনের।

সর্বাধিক বিপন্ন আন্টার্কটিকার পশ্চিমপ্রান্তের বেলিংসউসেন অঞ্চলটি। মোট পাঁচটি কলোনি আছে এখানে। এর মধ্যে চারটি কলোনিতেই শিশু পেঙ্গুইনের মৃত্যুসংখ্যার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। তুলনায় রথসচাইল্ড কলোনি-র অবস্থা কম ভয়াবহ। উপগ্রহ থেকে ধরা পড়েছে বরফ গলে যাওয়ার ছবি। ফলে শুধু ২০২২-এই নয়, এ বছরেও পেঙ্গুইনদের কলোনি গড়ে তুলতে পারার সম্ভাবনা কম। সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে দক্ষিণ মেরুতে বরফের পরিমাণ বাড়তে থাকে। অথচ এখনও পর্যন্ত সমুদ্রের জলের অত্যধিক উষ্ণতার জন্য পর্যাপ্ত বরফ তৈরি হয়নি।

আরও পড়ুন
দক্ষিণ আমেরিকায় ধেয়ে আসছে বিরাটাকার হিমশৈল, বিপন্ন পেঙ্গুইন ও সীলের প্রজাতি

বিজ্ঞানীরা এর জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী করছেন বিশ্ব উষ্ণায়ন ও গ্রিন হাউস গ্যাসের দাপটকে। বাতাসে কার্বনের পরিমাণ না কমালে ভবিষ্যতে আরও বিপদের সম্মুখীন হবে পেঙ্গুইনরা। অনুমান, এই শতাব্দীর শেষে অবলুপ্ত হয়ে যেতে পারে ৯০ শতাংশ এমপেরর পেঙ্গুইন। ২০১৬ থেকেই দক্ষিণ মেরুর বরফ দ্রুত গতিতে গলতে শুরু করেছে। গত দু-বছরে তা ভয়ানক আকার নিয়েছে। বিভিন্ন জায়গাতে সময়ের আগে গলতে শুরু করেছে বরফ। বিগত তিরিশ বছরে প্রায় ৬০ শতাংশ পেঙ্গুইন কলোনি নষ্ট হয়ে গেছে। তার মধ্যে ২০১৮ থেকে ২০২২-এর মধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৬০টি কলোনি। এবার আঘাত হানল বেলিংসউসেন অঞ্চলেও।

আরও পড়ুন
অবিশ্বাস্য দ্রুত হারে কমছে সংখ্যা, সংকটে পেঙ্গুইন

তবে বিপদ শুধু এমপেরর পেঙ্গুইনদেরই নয়। তাদের অবলুপ্তি ঘটলে সংকটে পড়বে সমগ্র আন্টার্কটিকার বাস্তুতন্ত্র। ছোট মাছ বা স্কুইড জাতীয় খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে জলের ভারসাম্য বজায় রাখে তারা। এমনিতে শান্তশিষ্ট হলে প্রায়ই লেপার্ড সিল-দের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। এমপেররদের অবলুপ্তি সমস্যায় ফেলবে অন্য প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবনকেও। ফলে ব্যাপকভাবে বিপদের মুখে আন্টার্কটিকার জীববৈচিত্র্য।

ইতোমধ্যে এমপেরর-দের ‘বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনা কি ক্রমশ ‘বিলুপ্তি’-র দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তাদের? জলবায়ু পরিবর্তনের রাশ টানা তো বটেই, কৃত্রিমভাবে তাদের সংরক্ষণ করা যায় কিনা, এটাই এখন গবেষণার বিষয়। নতুবা ‘এমপেরর’-রা রাজত্ব হারিয়ে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে অবলুপ্তির পথে।

Powered by Froala Editor