গিয়েছিলেন প্রতিবেশীর বিবাহে। খাওয়া দাওয়া, আনন্দ করার বদলে শেষ পর্যন্ত ধরুন আপনাকেই বসতে হল বিয়ের পিঁড়িতে। তাও বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে। না, কোনো গল্প-উপন্যাসের প্রেক্ষাপট নয়। বিহারে এমন ঘটনা ঘটে হামেশাই। উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পেলে, তাঁকে রীতিমতো অপহরণ করে বাধ্য করা হয় বিবাহ করতে। কখনো ভাড়া করা হয় ভাড়াটে গুণ্ডাও। স্থানীয় ভাষায় এই রীতি পরিচিত ‘পাকড়ুয়া বিবাহ’ (Pakadwa Vivah) নামে।
সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনা সাড়া ফেলে দিল গোটা ভারতবর্ষে। ছট পুজোর নিমন্ত্রণে বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলেন গয়ার সারবহনা গ্রামের ২২ বছর বয়সী যুবক গুড্ডু কুমার। ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যাওয়ায়, রাতটুকু তাঁকে থেকে যেতে বলেন তাঁর বন্ধু রাম দাস। রাজিও হয়ে যান তিনি। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তই যে অভিশাপ হয়ে ফিরত আসবে, তা কে জানত?
ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১০টা। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন গুড্ডু। তারপর হঠাৎ দরজায় টোকা। ঘরে হাজির খান সাতেক লোক। হাতে বন্দুক। বেশ অবাক হয়েছিলেনই তিনি। কিন্তু কেন এই অসময়ে তাঁদের হাজিরা, সে ব্যাপার ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসেনি তাঁর। তবে অবাক হওয়ার পালা বাকি ছিল তখনও। খানিক বাদেই স্বয়ং বন্ধু এসে দাবি করেন বিবাহ করতে হবে তাঁর অবিবাহিত বোনকে।
স্বাভাবিকভাবেই রাজি হননি তিনি। আর সেই কারণেই ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় গুড্ডুকে। শারীরিক অত্যাচার তো চলেই, প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয় রীতিমতো। হাত-পা বেঁধে রেখে দেওয়া হয় তিন ঘণ্টা। শেষ পর্যন্ত রাত ১টা নাগাদ জোর করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয় তাঁকে। বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে বাধা পড়তে হয় সাত পাকে। বিবাহের পর পুলিশের কাছে তিনি দ্বারস্থ হয়েছেন ঠিকই। কিন্তু স্থায়ী সমাধান দিতে এখনও ব্যর্থ পুলিশ প্রশাসনও।
আরও পড়ুন
শত্রুর মেয়েকে অপহরণ দলের, পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইলেন ‘দস্যুসম্রাট’ মালখান
গুড্ডু একা নন। প্রতি নিয়তই বিহারে ঘটে চলেছে এই ধরনের ঘটনা। পরিসংখ্যান দেখলে বছরে সংখ্যাটা তিন হাজারেরও বেশি। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ জন যুবক শিকার হচ্ছেন পাকড়ুয়া বিবাহের। আর সেই সংখ্যা প্রতিবছরই বেড়ে চলেছে ক্রমশ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ঘটনার শিকার হচ্ছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী চাকরিজীবী যুবকরা। কিন্তু তার কারণ কী?
আরও পড়ুন
শুধুই প্রেম নয়, হানিমুনের সঙ্গে জড়িয়ে অপহরণ ও ‘লুকিয়ে রাখা’র ইতিহাসও!
এর পিছনেও লুকিয়ে রয়েছে বিহারের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো। বিহারে ব্যাপকভাবে চল রয়েছে ‘দহেজ’ বা পণপ্রথার। কন্যাকে বিবাহ দিতে গেলে পাত্রপক্ষের হাতে বড়ো অঙ্কের টাকা তুলে দিতে হয় পাত্রীর পরিবারকে। সেইসঙ্গে যৌতুক তো আছেই। যত বয়স বাড়ে, তত বাড়তে থাকে এই হিসেবনিকেশের পরিমাণও। কিন্তু যাঁদের সেই সামর্থ্য নেই? বাধ্য হয়ে বিকল্প পথে হাঁটেন তাঁরা। বেছে নেন অপহরণের মাধ্যমে পাত্র খোঁজার পথ।
আরও পড়ুন
কখনও স্ত্রী-র ভয়, কখনও আবার স্বার্থসিদ্ধি; নিজেই নিজেকে অপহরণ করেছেন যে সব ব্যক্তি
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকাশ্যে আসে না এই ধরনের ঘটনাগুলি। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, পাকড়ুয়া বিবাহের সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল বিহারের স্থানীয় প্রশাসন। এমনকি সমস্ত কিছু জানার পরেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেয় না বিহারের পুলিশ। ফলে আদালত পর্যন্ত পৌঁছায় না মামলাও। নেই আলাদা আইনও। এই সমস্যার সমাধান ঠিক কী, তা জানা নেই আজও। তবে পণপ্রথার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলে হয়তো এই অপরাধের পথে হাঁটতে বাধ্য হবেন না কন্যাদায়গ্রস্ত পিতারা…
Powered by Froala Editor