কাঠের বক্সের গায়ে ছোট্ট বৃত্তাকার জানলা। সেখানে চোখ রাখলেই ফুটে উঠবে চলমান দৃশ্য। আজ থেকে কয়েক দশক আগেও গ্রাম বাংলায় হামেশাই দেখা মিলত এই যন্ত্রের। সামান্য টাকার বিনিময়ে দেখতে পাওয়া যেত নির্মেদ চলচ্ছবি। হ্যাঁ, বায়োস্কোপের কথাই হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ বায়োস্কোপ কেন? এই প্রতিবেদনের শিরোনামের সঙ্গে তার সম্পর্কই বা কী? আছে বৈকি। সেই গল্পেই যাওয়া যাক বরং।
আদতে বায়োস্কোপের জন্ম হয়েছিল কাইনেটোস্কোপ নামের একটি যন্ত্র থেকে। পর্যায়ক্রমে বেশ কিছু স্থির চিত্রকে সাজিয়ে তাকে গতিময়তার রূপ দেওয়া হত কাইনেটোস্কোপে। আর এই যন্ত্রটিরই জন্মদাতা ছিলেন থমাস আলভা এডিসন (Thomas A. Edison)। ১৮৯২ সাল সেটা। স্কটিশ বিজ্ঞানী লরি উইলিয়াম ডিকসনের সঙ্গে জুটি বেঁধেই কাইনেটোস্কোপ বানিয়েছিলেন বৈদ্যুতিক বালবের স্রষ্টা। যন্ত্রের গায়ে ছোট্ট সূচিছিদ্র দিয়ে দেখা যেত মোশান পিকচার্সের প্রিমিটিভ ভার্সান। বছর খানেক পর এডিসনের এই আবিষ্কারকেই বেশ খানিক বদল করে সিনেম্যাটোগ্রাফের জন্ম দেন ফরাসি বিজ্ঞানী লিও বউলি। তিনি প্রোজেক্টারের মাধ্যমে সেই চলচ্ছবিকে পর্দায় দেখানোর বন্দোবস্ত করেন।
আর এডিসনের সিনেমা? নিশ্চয়ই ভাবছেন, কাইনেটোস্কোপ তৈরির সময়েই পরীক্ষামূলকভাবে কোনো চলচ্চিত্র (Cinema) তৈরি করেছিলেন এডিসন? আজ্ঞে না। কাইনেটোস্কোপ আবিষ্কারেরও প্রায় এক দশক পরে চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন তিনি। সেই প্রসঙ্গে আসার আগে অবশ্যই বলে নেওয়া দরকার লুমিয়ার ব্রাদার্সের কথা। লিও বউলি সিনেম্যাটোগ্রাফ যন্ত্র তৈরি করলেও, আবিষ্কারের স্বীকৃতি পেয়েছিল লুমিয়ার ভাতৃদ্বয়ই। শুধুমাত্র অর্থিক অভাব থেকেই নিজের সৃষ্টি তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বউলি।
পেশাগতভাবে চলচ্চিত্র তৈরি শুরু করেন লুমিয়ার ব্রাদার্সই। সেটা ১৮৯৫ সাল। প্রকাশিত হয় ‘ওয়ার্কার্স লিভিং দ্য লুমিয়ার ফ্যাক্টরি’। লুমিয়ার ভাতৃদ্বয়ের এই কৃতিত্ব সেসময় রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল ইউরোপ ও আমেরিকায়। এই সিনেমা প্রকাশের মাস কয়েকের মধ্যেই চলচ্চিত্রের এই নতুন অধ্যায়ে নাম লেখাতে এগিয়ে আসেন একাধিক আলোকচিত্র শিল্পী এবং বিনিয়োগপতি। আর বাজারে সিনেম্যাটোগ্রাফ যন্ত্রের ঊর্ধ্বমুখী চাহিদা দেখেই মাঠে নামেন এডিসন। সিনেম্যাটোগ্রাফ ছাড়াও চলচ্চিত্র তৈরির অন্যান্য সমস্ত যন্ত্রাংশও তৈরি ও মেরামত করত তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘দ্য এডিসন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি’। শুধু যন্ত্র তৈরিই নয়, বছর খানেকের মধ্যে প্রযোজকের ভূমিকাতেও দেখা যায় তাঁকে। বানিয়ে ফেলেন আস্ত একটি প্রযোজনা সংস্থা ‘এডিসন ফিল্মস’।
আরও পড়ুন
নিজের আবিষ্কারের ওপরেই বিরক্ত এডিসন, নাম দিলেন ‘লিটল মনস্টার’
নিজে প্রযোজক হওয়ায় সেই সময়টায় একাধিক সিনেমা নির্মাণের কাজ সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এডিসন। বদল দেখেছিলেন সিনেমা শ্যুটিং-এর পদ্ধতিতেও। ফলত, চলচ্চিত্রের সমস্ত গলিঘুঁজিই জানা ছিল তাঁর। সেখান থেকেই তাঁর ইচ্ছে জাগে নিজে চলচ্চিত্র পরিচালনার। আর তা বেশ সফলভাবেই করে দেখান এডিসন। তৎকালীন সময়ে যা রীতিমতো সাড়াও ফেলে দিয়েছিল চলচ্চিত্রের জগতে।
আরও পড়ুন
কাজ করিয়েও টাকা দেননি এডিসন, প্রতিশোধে অল্টারনেটিং কারেন্ট আবিষ্কার টেসলা-র
এখানে মনে রাখতে হবে, সেই সময়ে চলচ্চিত্রের বিষয় ছিল অতিসাধারণ। মানুষের দৈনিক জীবনের কার্যকলাপ, চলমান ট্রেন কিংবা ছোট্ট শিশুর নড়াচড়াকে দেখানো হত সিনেম্যাটোগ্রাফের পর্দায়। ১৯০২ সালে এডিসনও তেমনটাই দেখালেন। তবে তাঁর চলচ্চিত্রের বিষয়টি একেবারেই আনকোরা ছিল পাশ্চাত্যের দর্শকদের কাছে। এডিসন তুলে আনলেন ভারতের মাদারিদের যাপনচিত্র, তাঁদের জাদুবিদ্যার শিল্পকলা, যোগ সাধনা। ১৯০২ সালে এডিসন পরিচালিত চলচ্চিত্রটির নাম ছিল ‘হিন্দু ফকির’। উল্লেখ্য, এটিই ছিল ভারতে শ্যুট হওয়া প্রথম চলচ্চিত্র। এবং আশ্চর্যের বিষয় হল সেই সিনেমায় অভিনেতা ছিলেন একজন বাঙালি জাদুকর। এ. এন. দত্ত।
আরও পড়ুন
এডিসনেরও ২০ বছর আগে সাউন্ড রেকর্ডার আবিষ্কার করেছিলেন এক বইবিক্রেতা
যাই হোক, ৩ মিনিটের সেই ছবিতে বেশ কিছু জাদুবিদ্যাকে ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন এডিসন। জাম্পকাট এবং মাল্টিপল শটের ব্যবহারে যা আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছিল ম্যাজিকাল। ‘যোগা: দ্য আর্ট অফ ট্রান্সফর্মেশন’ এগজিবিশনে দেখানোও হয়েছিল সেই ছবি। আজও যা সংরক্ষিত রয়েছে আমেরিকান মেমোরি অফ মোশান পিকচার্সে।
১৯১৮ সালে এডিসন কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে ‘দ্য গর্ডন সিস্টার্স’, ‘মার্ক টোয়েন’, ‘দ্য ট্রিক সাইক্লিস্ট’-সহ আরও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন এডিসন। তাছাড়াও মাত্র আড়াই দশকে সবমিলিয়ে প্রায় ৩৪১টি চলচ্চিত্র তৈরিতে অর্থ বিনিয়োগ করেছিল আলভা এডিসনের প্রযোজনা সংস্থা। যার মধ্যে এখনও অস্তিত্ব বজায় রেখেছে ১২৭টি ছবি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে থমাস আলভা এডিসনকে চলচ্চিত্রজগতের অন্যতম পথিকৃৎ বললেও ভুল হয় না খুব একটা। পরিচালনা থেকে শুরু করে সিনেমার প্রতি দর্শকদের মাদকতা জাগিয়ে তোলায় তাঁর গুরুত্বকে অস্বীকার করার সাধ্য নেই কারোরই। তবে সেই অধ্যায় থেকে গেছে আনকোরা হয়েই…
তথ্যসূত্রঃ
১. History of Edison Motion Pictures, Library Of Congress
২. National Museum Of Asian Art, Exhibition, Hindoo Fakir
৩. Early Films (Including One by Thomas Edison) Made Yoga Look Like Magic, Vicky Gan, Smithsonian Mag
৪. The Story of Yoga: From Ancient India to the Modern West, Alistair Shearer
Powered by Froala Editor