আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর আগে অরণ্যে বসবাস করত মানুষের পূর্বপুরুষরা। সোজা হয়ে দুপায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না তাদের। বৃক্ষ আরোহণে সুবিধা হওয়ার জন্যই এ-ধরনের শারীরিক গঠন ছিল তাদের। পাশাপাশি তাদের পা ও হাতের তালুর গঠনও ছিল আজকের মানুষের থেকে বেশ খানিকটা আলাদা। আঙুলের দৈর্ঘ্য ছিল আজকের গড় মানুষের থেকে লম্বা। আজও ‘এপ’ গোত্রীয় প্রাণী বা বিভিন্ন বাঁদর প্রজাতির মধ্যেও দেখা যায় এধরনের বৈশিষ্ট্য। বিশেষত তাদের পায়ের বুড়ো আঙুল ও অন্য চারটি আঙুলের মধ্যে দেখা যায় বিস্তর ফাঁক। কিন্তু মানুষের শারীরিক গঠনও যদি হুবহু এমন হয়?
হুয়াওরানি (Huaorani Tribe)। ইকুয়েডরের (Ecuador) আমাজন অরণ্যে বসবাস এই প্রাচীন উপজাতি জনগোষ্ঠীর। সবমিলিয়ে আজ তাদের সমাজ গঠিত প্রায় ৪০০০ সদস্য নিয়ে। বিশ্বের যে-কোনো প্রান্তের মানুষের ভাষার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এই উপজাতির ভাষা। এমনকি খোদ ইকুয়েডরের সবচেয়ে বেশি কথিত ভাষা কেচোয়ার থেকেও সম্পূর্ণ আলাদা হুয়াওরানি ভাষা। তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও ভিন্নস্বাদের। তবে শুধু ভাষা বা সংস্কৃতিই নয়, অবাক হতে হয় তাদের শারীরিক গঠন দেখেও।
হুয়াওরানি উপজাতির মানুষদের পায়ের গড়ন অনেকটা এপ বা বানর গোত্রের প্রাণীদের মতোই। পায়ের পাতার উপরের অংশ সাধারণ মানুষের মতো ফোলা নয়, বরং তা চ্যাপ্টা। হাত ও পা— উভয়ক্ষেত্রেই রয়েছে ৬টি করে আঙুল। সেগুলির আকারও সাধারণ মানুষের মতো সোজা নয়, বরং অর্ধচন্দ্রাকৃতিভাবে বাঁকা। পাশাপাশি পায়ের বুড়ো আঙুল ও অন্য আঙুলগুলির মধ্যে বিস্তর ফাঁক তাদের।
আসলে মূলত গাছে বসবাস করে এই অরণ্যবাসী উপজাতি। আর সেই কারণেই পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে এই বিশেষধরনের শারীরিক অভিযোজন। পায়ের আঙুলের মাঝে ফাঁক কিংবা ৬টি আঙুলের উপস্থিতি আসলে বৃক্ষ আরোহণের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সাহয্য করে তাদের। অবশ্য মজার বিষয় হল, জন্ম থেকেই তাদের পায়ের গড়ন এমনটা হয় না। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে সোজাই থাকে হাত ও পায়ের আঙুল। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ সেগুলি বেঁকে যায়। তাদের আকার হয়ে যায় অনেকটা চাঁদের মতো।
সাধারণত গাছের ফল ও ছোটো বাঁদর গোত্রীয় প্রাণী শিকার করেই জীবননির্বাহ করে এই প্রাচীন জনজাতি গোষ্ঠী। প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে বর্শা এবং বাঁশের তৈরি এক বিশেষ ধরনের পাইপ, যা দিয়ে ছোঁড়া যায় বিষাক্ত তীর।
আরও একটি আশ্চর্যের বিষয় হল, অন্যান্য প্রাচীন জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষের মতোই সমাজজীবনে অভ্যস্ত হলেও হুয়াওরানিদের কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নেই। বরং সমাজের সবকিছুই সাধারণ সম্পদ। খাদ্য থেকে শুরু করে পোশাক-আশাক— পারস্পরিক আস্থা এবং বোঝাপড়ার মাধ্যমেই তা সমানভাবে ব্যবহার ও ভাগ করে নেয় হুয়াওরানি উপজাতির মানুষরা।
তবে হুয়াওরানিরা বিবর্তন এবং অভিযোজনের পথে হাঁটা পৃথিবীর একমাত্র মানবগোষ্ঠী নয়। মালয়েশিয়াতেও বাজাই লাউতরা গোষ্ঠীর মানুষদের রয়েছে আশ্চর্য ক্ষমতা। সমুদ্রবাসী এই উপজাতির মানুষরা জলের নিচে শ্বাস ধরে রাখতে পারে প্রায় ১৩ মিনিট। এই আশ্চর্য ক্ষমতার নেপথ্যেও রয়েছে অভিযোজনের হাত। বর্তমানে দ্রুত বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ু। বদলাচ্ছে পৃথিবীর প্রাকৃতিক গঠনও। ফলে, আজকের ‘সাধারণ’ মানুষকেও আগামীদিনে অভিযোজনের পথে হাঁটতে হবে— এমনটা যেন ভবিতব্য। কেমন হবে তার শারীরিক গঠন? কোন কোন ক্ষমতাই-বা মুষ্টিবদ্ধ করবে সে? আজও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন গবেষকরা…
Powered by Froala Editor