পাহড়ের কোলে নীল হ্রদ। আর সেই হ্রদকে ঘিরে ছোট্ট কয়েকটা ছোটো ছোটো জনপদ। সব মিলিয়ে জনসংখ্যা ৫০ হাজারের কিছু বেশি। তবে তাঁরা বাকি পৃথিবীর থেকে একেবারেই আলাদা। কারণ আর কিছুই না। এখানে কেউই তাঁর পিতৃপতিচয় জানেন না। এমনকি এই সমাজে নারী হয়ে জন্মানোই সবচেয়ে সৌভাগ্যের বিষয়। পুরুষদের প্রায় কোনো অধিকারই নেই। সমাজে পুরুষের ভূমিকা কেবল প্রজননের ক্ষেত্রে। কৃষিকাজ থেকে পশুপালন, সবই করেন মহিলারাই।
চিনের ইউনান প্রদেশে রয়েছে মসুও নামের এই মাতৃতান্ত্রিক উপজাতি সম্প্রদায়। ঐতিহাসিকদের অনেকেই মনে করেন, মানুষের সভ্যতা প্রথমে মাতৃতান্ত্রিকই ছিল। কালক্রমে পরিবার ব্যবস্থার জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিতৃতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু মসুও উপজাতি আটকে গিয়েছে সেই মাতৃতান্ত্রিক সমাজেই। অবশ্য অনেক ঐতিহাসিক এই মত মানতে চান না। তাঁদের মতে, মসুও উপজাতির সংস্কৃতি তত প্রাচীন নয়। মধ্যযুগের কোনো এক সময় এই সম্প্রদায়ের বিকাশ ঘটেছে। সেই সময় চিনের প্রচলিত সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন বেশ কয়েকজন মহিলা। আর তাই এই সংস্কৃতি শুধুই মাতৃতান্ত্রিক নয়, তা পুরুষের যাবতীয় অধিকারকেই নাকচ করে। ঠিক যেমন সামন্ততান্ত্রিক সময়ে নারীর কোনো অধিকারকেই স্বীকৃতি দিত না সমাজ।
মসুও পরিবারে সর্বময় কর্ত্রী পরিবারের সবচেয়ে বরিষ্ঠ নারী। মা, মাতামহী বা প্রমাতামহীর কথা শুনেই চলেন সকলে। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর মেয়েদের মধ্যে থেকে বেছে দিয়ে যান পরবর্তী কর্ত্রীকে। তবে এই নির্বাচন বয়সের ভিত্তিতে হয় না। বরং কর্মদক্ষতায় যে মেয়েটি সবচেয়ে এগিয়ে, সেই উত্তরাধিকার পায়। পরিবারের যাবতীয় সম্পত্তির মালিকানা থাকে তার হাতেই। বোনেদের মধ্যে বিবাদ হলে সম্পত্তি ভাগ করা যেতে পারে, কিন্তু পুরুষদের কোনোভাবেই সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হয় না। পুরুষদের যাবতীয় দায়িত্ব নেন বোনেরা।
মসুও উপজাতির মধ্যে বিবাহের কোনো নিয়ম নেই। এখানে বিবাহের নাম ‘ওয়াকিং ম্যারেজ’ বা পথচলতি বিয়ে। কেমন সেই রীতি? ধরা যাক হঠাৎ কোনো পুরুষকে দেখে পছন্দ হল কোনো মহিলার। তিনি পুরুষটিকে গিয়ে বলবেন, ‘আজ রাতে আমার ঘরে এসো।’ পুরুষটি সেই রাতে গ্রামের সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর দরজায় টোকা দেবে। সেই এক-রাতের জন্য তাঁরা বিবাহিত। কিন্তু সূর্য ওঠার আগেই পুরুষটি ফিরে যাবেন নিজের গৃহে। কেউ জানতে পারবে না সেই বিবাহের কথা। এমনকি সন্তানও জানতে পারবে না পিতৃপরিচয়। সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব মায়েদের উপরেই।
আরও পড়ুন
আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধের শহিদ মিনার স্থানান্তর, সরব নাগরিক সমাজ
গাছ, পাথর আর পাহাড়ের পূজারি মসুও উপজাতি। তাঁদের ধর্মে সবচেয়ে বড়ো দেবী হলেন পাহাড়। আর পাহাড়ের দেবী নিজে মদ্যপায়ী। তিনি একাধিক পুরুষের সঙ্গ পছন্দ করেন। মসুও নারীরাও পাহাড়ের দেবীকেই অনুসরণ করেন। অবশ্য মসুও নারী মানেই কিন্তু বহুগামী নন। বাইরের পৃথিবীতে এই একটি ভুল ধারণা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। কিন্তু একথা মাথায় রাখতেই হবে, সন্তানের জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে যাবতীয় শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় মাকেই। আর উপজাতির মানুষদের মধ্যে তো জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রচলনও নেই। তাই অধিকাংশ মহিলাই জীবনে একজন পুরুষকেই বিবাহ করে থাকেন। যদিও যাঁরা অধিক বিত্তশালী, খাওয়া-পরার জন্য যাঁদের কায়িক শ্রম না করলেও চলে, তাঁরা একাধিক বিবাহ করে থাকেন।
আরও পড়ুন
দীর্ঘ ৪১ বছর অরণ্যবাস, ভিয়েতনামের ‘টারজান’ জানেন না নারীজাতির অস্তিত্ব সম্পর্কেও!
হ্যাঁ, এই একুশ শতকেও এমন একটা জনজাতির অস্তিত্ব অবাক করে বৈকি! তবে ক্রমশ তাঁদের মধ্যেও এসে পড়ছে আধুনিকতার ছাপ। মসুও উপজাতির মহিলারাও চিনের কোনো শহরে বসে পরিবার নিয়ে শান্তিতে ঘরকন্না করছেন, এমনটা দেখা যায় প্রায়ই। শুধু যা থেকে গিয়েছে, তা হল মহিলাদের আত্মবিশ্বাস। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মহিলারা দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়িত হতে হতে আত্মবিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলেছেন। এই একটি ব্যতিক্রম হয়তো চিরকাল চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেবে তাঁদের পরিচয়। অথবা দুই সমাজের সংঘাতে সত্যিই তৈরি হবে এক লিঙ্গসাম্যের পরিবেশ।
আরও পড়ুন
বিয়ের পর পুরুষরাই যান শ্বশুরবাড়ি, ভারতের বুকেই রয়েছে এমন মাতৃতান্ত্রিক সমাজ
তথ্যসূত্রঃ The kingdom of women: the society where a man is never the boss, Hannah Booth, The Guardian
Powered by Froala Editor