নেই কোনো প্রবেশ-প্রস্থান, মুহূর্তদের উপভোগ করতে শেখায় জাপানের এই রেলস্টেশন

পাহাড়ের গা ঘেঁষেই চলে গেছে সিঙ্গেল রেললাইন। ছবির মতো সাজানো দৃশ্যপট। একদিকে রঙিন ফুলে মোড়া পাহাড়ের শরীর। অন্যদিকে খাদ। ছুটে চলেছে খরস্রোতা নদী। সেই পাহাড়ের কোলেই যেন ঝুলন্ত একটি স্টেশন। সাজানো, ছিমছাম। ছোট্ট ট্রেন এসে থমকালো সেই প্ল্যাটফর্মে। নামলেন কিছু মানুষও। কিন্তু কোথায় যাবেন তাঁরা? উত্তর কোথাও নয়! নিশ্চয়ই ভাবছেন, এ কেমন হেঁয়ালি। হেঁয়ালি নয়, বাস্তবেই কোথাও যাওয়ার নেই একবার এই স্টেশনে নেমে পড়লে। কারণ স্টেশনের প্রবেশ বা প্রস্থানের জন্য কোনো পথই বানায়নি কর্তৃপক্ষ।

কথা হচ্ছে জাপানের সেরিয়ু মিহারাশি স্টেশন নিয়ে। কোনো প্রযুক্তিগত ভুল নয়। পরিকল্পনা মাফিকই জাপান রেল কর্তৃপক্ষ তৈরি করেছে এই স্টেশন। আসলে এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত ব্যস্ততা বেড়ে চলেছে মানুষের জীবনে। এই গতিময়তায় ফাঁকে দম ফেলার সুযোগটুকু সত্যিই কি রয়েছে আমাদের? এর রেশ পিছু করে বেড়ায় কোথাও ভ্রমণে গেলেও। প্রকৃতিকে উপভোগ করার বদলে কম সময়েই বেশি জায়গা ঘুরে ফেলার প্রবণতা থাকে অনেকের মধ্যেই। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানুষকে বের করে আনতেই এমন উদ্যোগ জাপান রেলের। 

‘সেরিয়ু মিহারাশি’— কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘ক্লিয়ার স্ট্রিম ভিউয়িং প্ল্যাটফর্ম’ বা নদী পরিদর্শনের স্টেশন। নিরিবিলিতে শান্ত পরিবেশে যাতে দু’দণ্ড মানুষ দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে পারে প্রকৃতিকে, সে জন্যই তৈরি করা হয়েছে এটি। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে চালু হয় জাপানের এই রেলস্টেশনটি। দক্ষিণ জাপানের নিশিকিগাওয়া সেরিয়ু লাইনের সঙ্গে যুক্ত করা হয় মিহারাশিকে। সরু ন্যারো গেজ লাইন ধরে কেবলমাত্র একটিই এক কামরার ট্রেন যাতায়াত করে এই লাইনে। সকালে যাত্রীদের স্টেশনে নামিয়ে আবার সন্ধেবেলা ফেরত নিয়ে যায় তাঁদের। মাঝের সময়টুকু বরাদ্দ শুধুমাত্র পাথুরে নিশিকি নদীর শব্দ আর পাখিদের কলরবের জন্য। তবে চাইলে ১০ মিনিটের জন্য এই প্ল্যাটফর্মে নেমে, আবার ট্রেনে উঠে পড়ার স্বাধীনতাও রয়েছে যাত্রীদের। ‘অভিনব’ বললেও বোধ হয় একটু কম বলা হয়ে যায় এই উদ্যোগকে।

জাপানের রেল পরিষেবা বিশ্ববন্দিত। শুধু এই স্টেশনই নয়। এর আগেও বেশ কিছু আশ্চর্যকর ঘটনার কিংবদন্তি রচনা করেছে জাপান রেল। ২০১৬ সালের কথা। কামি-শিরাতাকি স্টেশন। প্রকাশ্যে আসে সেখানে দিনে আপ-ডাউন মিলিয়ে মাত্র দুটি ট্রেন থামে। কেননা সেই স্টেশন দিয়েই যাতায়াত করে একজন ছাত্রী। শুধু তার জন্যই আস্ত একটি রেলস্টেশন। আর স্কুলের সময়ানুযায়ীই সেখানে বন্দোবস্ত করা হয়েছে যাতায়াতের দুটি ট্রেন।

অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই? এক বছর পরের আরেকটি ঘটনা শুনলে আরও অবাক হবেন। ২০১৭ সালে এক ভয়ানক অপরাধ করে ফেলায় প্রকাশ্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করে জাপান রেলকর্তৃপক্ষ। ভুলবশত সেবার ২৫ সেকেন্ড আগে স্টেশনে ট্রেন প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিল রেলচালক। আর তাতেই রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায় গোটা জাপান জুড়ে। 

যাই হোক, মিহারাশি প্রসঙ্গে ফেরা যাক। অনন্য এই প্ল্যাটফর্মে জীবনে অন্তত একবার না গেলে অপূর্ণ থেকে যাবে অভিজ্ঞতার অনেকটা ভাণ্ডার। কাজেই জাপান ভ্রমণের সুযোগ এলে এমন একটি জায়গায় ঢুঁ না মারা, খানিকটা বোকামিই হবে। এমন মনোরম পরিবেশে একাকিত্বের স্বাদ চেখে দেখা ‘সৌভাগ্য’-র থেকেও বড়ো। আর সঙ্গে গান থাকে, তবে তো কথাই নেই। কানে কানে কবীর সুমন বলে উঠবেন, “আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই…”

আরও পড়ুন
ছোট্ট সাইবার ক্যাফেতেই রোজের সংসার, একাকিত্বের বিরুদ্ধে জাপানি দম্পতির লড়াই

Powered by Froala Editor