বাঙালির তেরো পার্বণের বাইরে অন্যতম আরেকটি উৎসব হল পৌষমেলা। প্রতি বছরই শীতকালে ভিড় জমান হাজার হাজার বাঙালি। লালমাটির বোলপুরের টানে ছুটে আসেন বিদেশি পর্যটকরাও। কিন্তু এবছর বন্ধ থাকছে সেই উৎসবের আমেজই। শীতের মরশুমেও করোনা আবহে ধূ-ধূ করবে পরিচিত পূর্বপল্লীর মাঠ।
শুক্রবার শান্তিনিকেতনে রথীন্দ্র অতিথি গৃহে একটি বৈঠক আয়োজিত হয়েছিল। সেই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয় পৌষমেলার বিষয়ে। উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য-সহ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির সদস্যরা। এই বৈঠকেই ঠিক করা হয়, মহামারীর কারণে বন্ধ থাকবে এবছরের পৌষমেলা। তবে মেলা বন্ধ থাকলেও উৎসব পালনে ত্রুটি থাকছে না কোনো। ৭ পৌষ থেকেই রীতি মেনে চলবে উপাসনা, মহর্ষি স্মারক বক্তৃতা। পালিত হবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং খ্রিষ্টোৎসব-ও।
১৮৪৩ সাল অর্থাৎ ১২৫০ বঙ্গাব্দের ৭ পৌষ শুরু হয়েছিল এই মেলা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের মাধ্যমেই সূত্রপাত হয়েছিল পৌষউৎসবের। ভুবনডাঙার ছোট্ট মাঠেই আয়োজন হয়েছিল মেলার। ক্রমে বাড়তে থাকে তার পরিধি। মেলা উঠে আসে পূর্বপল্লীর মাঠে। তবে তার রেশ ছড়িয়ে থাকে খোয়াইয়ের ধার অবধি।
বোলপুরের পৌষমেলা আর সাংস্কৃতিক সমাগম যেন একে অপরের পরিপূরক। মেলার শুরু যেমন হয় সানাইয়ের সুরে, বৈতালিক গানে। তেমনই শীতের ছুটির দিনগুলোয় শান্তিনিকেতন ঘিরে ছড়িয়ে থাকে বাউলের সুর। মুখোশনৃত্য, রণ-পা, ছৌনাচ বাদ যায় না কিছুই। পাশাপাশি এই মেলা সামাজিক মেলবন্ধনের চিহ্ন-ও। যেখানে ব্রহ্মচর্চায় বৈদিক পাঠের সমান্তরালে পালিত হয় যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন।
আরও পড়ুন
চিকিৎসকই ‘আচার্য’, দীর্ঘ বিরতির পর শান্তিনিকেতনে শুরু হল উপাসনা
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন এই মেলা শুরু করেন, তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়। উদ্দেশ্য ছিল কেবলমাত্র আশ্রম প্রতিষ্ঠার বাৎসরিক উৎসব পালন। কিন্তু ১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ দেশের অর্থনীতিকে সারিয়ে তোলার লক্ষ্যেই জোর দিয়েছিলেন মেলায়। স্বদেশি আন্দোলনকে গুরুত্ব দিয়েই স্থানীয় পণ্যের বিক্রির কথা ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তৈরি করেছিলেন ‘স্বদেশী সমাজের সংবিধান’।
আরও পড়ুন
অন্তিম জন্মদিন কাটল শান্তিনিকেতনেই, কাছের মানুষেরা ঘিরে রইলেন কবিকে
লালমাটির বোলপুর সেই বিবর্তনের পর থেকেই পৌষমেলার ওপরে আজও যে আর্থিকভাবে নির্ভরশীল তা না বললেও চলে। বছরের এই সময়টার ওপরেই জীবিকা নির্ভর করে অসংখ্য মানুষের। মেলা বন্ধ হওয়ায় সঙ্কটের মুখোমুখি তাঁরা। তাই প্রাক্তনী এবং আশ্রমিকরা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও ক্ষুব্ধ এলাকার ব্যবসায়ী সমিতি। অনেকেই অভিযোগ জানিয়েছেন এ বিষয়ে।
আরও পড়ুন
হারাচ্ছে আলপনার ঐতিহ্যও, নববর্ষ ঘিরে আক্ষেপ শান্তিনিকেতনের শিক্ষকের
পৌষমেলার কারণে ক্রমাগত দূষিত হচ্ছে অঞ্চল। গত বছর সেই অভিযোগেই আদালতে উঠেছিল পৌষমেলার ভাগ্য। তাও শেষমেশ সতর্কতার সঙ্গে আয়োজিত হয়েছিল মেলা। কেবলমাত্র রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ১৯৪৩ এবং ১৯৪৬ সালে বন্ধ ছিল পৌষমেলা। কারণ ছিল মন্বন্তর এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। কিন্তু তারপর কোনোদিনও থেমে যায়নি এই উৎসবের রেশ। ৭৪ বছর পর এই বছর ছেদ পড়ছে সেই ঐতিহ্যবাহী ধারায়। অন্যদিকে এবছরে ভাইরাসের সংক্রমণে বাতিল হয়েছিল দোল উৎসব-ও। মহামারীর কারণে পরবর্তী দোল উৎসব-ও যে বন্ধ থাকবে, এদিন তা জানিয়েছে বিশ্বভারতী।
আরও পড়ুন
প্লাস্টিক সংগ্রহ করতে বেরিয়েছে টোটো, অভিনব উদ্যোগ শান্তিনিকেতনে
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
শান্তিনিকেতনে পড়াতে ডাকলেন রবীন্দ্রনাথ, সঙ্গে-সঙ্গে চাকরিতে ইস্তফা লীলার