১৯৮০ সালের কথা। তখনও সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে ইউক্রেনের (Ukraine) জন্ম হয়নি। ক্রামাতোরস্ক শহরের বিরাট বাড়িটির ৮৫ নম্বর ঘরে উঠে এল একটি পরিবার। বাড়িটি নিয়ে খানিক রেশারেশি ছিল অনেকের মধ্যে। সর্বক্ষণ গরম জলের ব্যবস্থা, ঝাঁ-চকককে লিফট আর বড়ো বড়ো ঘর—মারিয়ি প্রাইমেচেংকো স্ট্রিটে এমন বাড়ি পাওয়া খুবই মুশকিল। আর কী চাই নতুন অতিথিদের? কিন্তু না চাইতেও এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন তাঁরা। অল্পদিনের মধ্যেই ফুরিয়ে গেল তাঁদের সুখের সংসার। কারণ, এক বছরের মধ্যেই লিউকেমিয়ায় (Leukemia) আক্রান্ত হল তাঁদের আঠারো বছর বয়সী কন্যা। মাস কয়েকের মধ্যেই মৃত্যু হল তার।
দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কাকেই বা দোষ দেবে পরিবারটি? ক্যান্সারের সঙ্গে তো লড়াই চলে না। মেয়ের স্মৃতি নিয়েই বাকি জীবনটা কাটানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু ফের নেমে এল আঘাত। এবার লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হল বাড়ির ষোলো বছরের পুত্রসন্তান। না, বাঁচানো গেল না তাকেও। পুত্র-কন্যাকে হারিয়ে নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়ার আশা হারিয়ে ফেললেন দম্পতি। কিন্তু বেশি দিন এই বেদনা ভোগ করতে হল না দুজনকে। কয়েক মাসের মধ্যে মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেল স্ত্রীকে। এবারও মৃত্যুর কারণ সেই এক রোগ—লিউকেমিয়া। একই ছাদের তলায়, একই রোগের মৃত্যুকে সমাপতন বলে উড়িয়ে দেওয়ার সাহস দেখাল না আর কেউ। নিশ্চয়ই কোনো ‘অভিশাপ’ আছে বাড়িটিতে। এই বদ্ধমূল ধারণার কারণে বেশ কিছু বছর পরিত্যক্ত হয়ে রইল বাড়িটি।
স্বাভাবিকভাবেই কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ল পুরো ঘটনা। ‘অভিশাপ’-এর গুজবকে আমল দেওয়া উচিত নয়। তাই ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে জানানো হল, লিউকেমিয়ার প্রবণতা তাঁদের বংশগত। নিশ্চয়ই দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের শরীরের বাসা বেঁধেছিল এই রোগ। কেউ বিশ্বাস করল, কেউ করল না। চের্নোবিলের দুর্ঘটনা ঘটতে তখনও বাকি আছে কয়েক বছর। যাই হোক, কিছুদিনের মধ্যে থিতিয়ে পড়ল সমস্ত আলোচনা। ১৯৮৭-তে ওই ঘরের চাবি তুলে দেওয়া হল অন্য একটি পরিবারের হাতে।
মাত্র কিছুদিনের অপেক্ষা। ফের আঘাত হানল দুরারোগ্য কর্কট রোগ। পরিবারের সদাচঞ্চল, ফুটফুটে কিশোরটির শরীরে ধরা পড়ল লিউকেমিয়া। তার মৃত্যুর কদিন পরে অত্যন্ত গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় বাড়ির সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্যকে। সে অবশ্য প্রাণে বেঁচে যায়। কিন্তু সন্তান হারানো বাবা দাবি করেন তদন্তের। পুরো বিষয়টির প্রচার বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে জনসমর্থনও বাড়ে তদন্তের জন্য। দীর্ঘ দু’বছরের লাগাতার আন্দোলনের পর কর্তৃপক্ষ রাজি হয় সরেজমিনে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে।
আরও পড়ুন
এক বাড়িতেই থাকে গোটা শহর! কোথায়?
পরীক্ষায় যা পাওয়া গেল, তা সকলকে চমকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ঘরের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে উচ্চ তেজস্ক্রিয়তা। বিশেষ করে, শিশুদের শোওয়ার ঘরের অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। কোনো মানুষের শরীরের পক্ষেই সম্ভব নয় ওই রেডিয়েশনকে প্রতিরোধ করা। আর তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে একটি বিশেষ দেওয়ালে। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে ফেলা হয় দেওয়ালটি। কী পাওয়া যায় সেখান থেকে? উচ্চমাত্রায় তেজস্ক্রিয় একটি সেসিয়াম-১৩৭ (Caesium-137) ক্যাপসুল। কীভাবে সেটা এখানে এল সেটাও কম আশ্চর্যের নয়। ক্যাপসুলের ক্রমসংখ্যা মিলিয়ে দেখা গেল, সেটি পাওয়া গেছিল কারানস্কি খনিতে। কোনোভাবে সেটি মিশে যায় সেখানকার নুড়ি-পাথরের সঙ্গে। পরে সেই ইট দিয়েই তৈরি হয় মারিয়ি প্রাইমেচেংকো স্ট্রিটের বাড়িটি। তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখা হয় বাড়ির প্রতিটি অংশের তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা। শুধু ৮৫ নম্বর ঘরটি নয়, ৫২ নম্বরের বাসিন্দাদের শরীরেও পাওয়া যায় লিউকেমিয়ার লক্ষণ।
আরও পড়ুন
বাড়ি না সমুদ্রের ঢেউ? অবাক করে পোল্যান্ডের এই 'পাড়া'টি
চারজন মানুষের মৃত্যু ও আরো সতেরো জন আক্রান্ত হওয়ার পরে অবশেষে পাওয়া যায় রহস্যের সন্ধান। ৭ নম্বর বাড়িটি কিন্তু আজও দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়।
Powered by Froala Editor