৩ লক্ষ ইঁদুরের দৌরাত্ম্য, বেহাল হতে বসেছিল এই দ্বীপ!

প্রশান্ত মহাসাগরের স্বচ্ছ নীল জলরাশি। আর তার মাঝেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোট্ট একটি পাহাড়ি দ্বীপ। সেইসঙ্গে প্রবাল প্রাচীরের উপস্থিতি তো রয়েছেই। সবুজ গাছগাছালিতে মোড়া এই দ্বীপ যেন আক্ষরিক অর্থেই স্বর্গরাজ্য। সিডনি থেকে ৭৮০ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত প্রাশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপটি স্থানীয়দের কাছে পরিচিত লর্ড হাউয়ি আইল্যান্ড (Lord Howe Island) নামে। তবে আজ থেকে বছর দুয়েক আগেও এই দ্বীপে রাত কাটানো ছিল এক প্রকার বিভীষিকা। হ্যাঁ, প্রাণ হাতে নিয়েই ফিরতে হত এই দ্বীপ থেকে। 

না, বাঘ-ভাল্লুক কিংবা হিংস্র প্রাণীদের উপস্থিতির কারণে নয়। এই দ্বীপে মানুষের প্রধান শত্রু ইঁদুর (Rats)। অবাক লাগলেও এমনটাই সত্যি। ৩ লক্ষাধিক ইঁদুরের বসবাস প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই দ্বীপে। ইঁদুরের উপদ্রবে জামাকাপড় কিংবা তাঁবু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া তো বটেই, সামান্য অসাবধনতা প্লেগ কিংবা ভয়াবহ রোগেরও কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদিও ইঁদুরের সঙ্গে মোকাবিলা করেই এতদিন সেখানে বসবাস করে এসেছেন হাজার খানেক মানুষ। প্রশ্ন থেকে যায়, এই দ্বীপে ইঁদুরের এই দৌরাত্ম্যের কারণ কী? 

শুনলে আশ্চর্য হবেন, ইঁদুর বা রোডেন্ট গোত্রের প্রাণীরা কিন্তু এই দ্বীপের আদিবাসিন্দা নয়। লর্ড হাউয়ি-তে ইঁদুরের আগমন হয়েছিল ১৮০০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে। জাহাজডুবির মাধ্যমে। তৎকালীন সময়ে এই দ্বীপ সংলগ্ন সমুদ্র ছিল অন্যতম দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা। দ্বীপের কাছে প্রবালপ্রাচীরের অস্তিত্বই বার বার জাহাজডুবির কারণ হয়ে দাঁড়াত। আর মানুষের মতো প্রাণ বাঁচাতে এই দ্বীপে আশ্রয় নিত জাহাজের ইঁদুররাও। অবশ্য নথি বলছে, সেগুলি ছিল মূলত আকারে ছোটো নেংটি ইঁদুর। লর্ড হাউয়ি দ্বীপে বড়ো ইঁদুরের আগমন ঘটে ১৯১৮ সালে। হ্যাঁ, সেই ঘটনার সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে জাহাজডুবি। 

লর্ড হাউয়ি দ্বীপ ইঁদুরের আদি বাসভূমি ছিল না কোনোদিনই। সে-কথা উল্লেখ করা হয়েছে আগেই। স্বাভাবিকভাবেই ইঁদুরের উপস্থিতি না থাকায়, কয়েক শিকারি পাখি প্রজাতি ছাড়া এই দ্বীপে ইঁদুরের খাদক প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে, বিঘ্নিত হয় খাদ্য-খাদক শৃঙ্খলের ভারসাম্য। দ্রুত গতিতে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে ইঁদুরের। একুশ শতকের শুরুতে পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে যায় ৩ লক্ষের মাত্রা। 

আরও পড়ুন
মুহূর্তেই কঠিন হবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, পথ দেখাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া

শুধু মানুষই নয়, ইঁদুরের এই বাড়বাড়ন্ত রীতিমতো বিপর্যস্ত করে তুলেছিল লর্ড হাউয়ি দ্বীপের বাস্তুতন্ত্রকেও। ইঁদুরের তাণ্ডবে বিপন্নপ্রায় প্রাণীদের তালিকায় নাম লিখিয়েছিল একাধিক স্থানীয় প্রজাতির পাখি, পোকামাকড় এবং ছোটো প্রাণী। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই ইঁদুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে অস্ট্রেলিয়া প্রশাসন। 

আরও পড়ুন
তাঁবুর নিচে দূতাবাস! ৫০-এ পা দিল অস্ট্রেলিয়ায় আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের পীঠস্থান

২০১৯ সালে সবমিলিয়ে ৪২ টন বিষযুক্ত খাবার ছড়ানো হয় এই দ্বীপে। সেইসঙ্গে পাতা হয়েছিল প্রায় ২২ হাজার ফাঁদ। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিকারি কুকুরও নিযুক্ত করা হয়েছিল ইঁদুর মারার জন্য। পরিবেশ সংরক্ষণে একটি বিশেষ প্রজাতিকে নির্মূল করার এ-হেন উদাহরণ খুব কমই দেখা যায় পৃথিবীর ইতিহাসে। ১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই প্রোজেক্ট তৎকালীন সময়ে বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছিল বিশ্বজুড়ে।

আরও পড়ুন
মাকড়সার জালে ঢাকা একাধিক শহর, অবাক করা দৃশ্য অস্ট্রেলিয়ায়

যদিও ২০১৯ সালের ইঁদুর নির্মূলীকরণ অভিযান শেষ পর্যন্ত ভাগ্য ফেরায় অস্ট্রেলিয়ার এই দ্বীপের। বর্তমানে আবার নতুন করে সেজে উঠেছে লর্ড হাউয়ির বাস্তুতন্ত্র। রং ফিরেছে প্রকৃতির। তবে লর্ড হাউয়ির সমস্যা মিটলেও, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অংশে এখনও মানুষের সঙ্গে সংঘাত লেগেই রয়েছে ইঁদুরের…

Powered by Froala Editor