প্রত্যাশিত সমস্ত সমীকরণই পাল্টে যায় ময়দানে। এটাই খেলার নিয়ম। আর সেই নিয়ম মেনেই জন্ম নেয় ডার্কহর্সরা। তেমনই এক ডার্কহর্স ফুটবল ক্লাব রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিয়েছে মার্কিন ফুটবল দুনিয়ায়। বিগত ৮০ বছরের ইতিহাসে মাত্র ২ বার ‘আমেরিকান ফুটবল কনফারেন্স’-এ (AFL) জায়গা পেয়েছে এই দল। তাও দৌড় সীমিত ছিল গ্রুপ পর্যায় পর্যন্তই। এবারেও এএফএল-এ দুর্বলতম দল হিসাবেই খেলতে নেমেছিল তারা। অথচ, সকলকে চমকে দিয়েই গ্রুপ পর্যায়ে শীর্ষস্থান দখল করে সেমিফাইনালে জায়গা পাকা করে নিল অখ্যাত এই ক্লাব (Football Club)।
না, নতুন ক্লাবের উত্থান নিয়ে আলোচনা করার জন্য এই প্রতিবেদন নয়। বরং, এই আলোচনার মুখ্য বিষয় হল ফুটবল ক্লাবটির নাম— ‘সিনসিনাটি বেঙ্গলস’ (Cincinnati Bengals)। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন বেঙ্গল। এএফএলের টেবিল খুললে ‘বেঙ্গলস’ নামটি দেখে অবাক হবেন যে-কোনো বাঙালিই। তবে কি মার্কিন-নিবাসী বাঙালিরাই এই ফুটবল ক্লাব পরিচালনা করেন? বাঙালি ফুটবলাররাও নিশ্চয়ই রয়েছেন এই ক্লাবের প্লেয়ার লিস্টে? হতেই পারে। গানে তো আছেই ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’।
না, ব্যাপারটা একেবারেই তেমন নয়। ১৯৩৭ সালে ওহিও প্রদেশের সিনসিনাটি শহরে জন্ম হয়েছিল এই ফুটবল ক্লাবের। পরবর্তী ৮৫ বছরের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোনো বাঙালি ফুটবলার পা রাখেননি এই ক্লাবের মাটিতে। কর্তৃপক্ষেও নেই কোনো বঙ্গসন্তান। তবে হঠাৎ নিখাদ মার্কিন ফুটবল ক্লাবের এমন নাম কেন?
আরও পড়ুন
রবি-সন্ধ্যায় ‘নাটকীয়’ ফুটবল ফাইনাল, বাজিমাত করল কারা?
সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে সাড়ে আট দশক। ক্লাবের জন্মলগ্নে। সে এক মজার গল্প। ১৯৩৭ সালে ওহিও এই ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মার্কিন ফুটবলার তথা কোচ হাল পেনিংটন। অর্থায়নের ব্যবস্থাও হয়ে গিয়েছিল সবরকম দিক থেকেই। কিন্তু কী নাম হবে এই ক্লাবের? তা নিয়েই বেশ ধন্ধে ছিলেন স্বয়ং প্রতিষ্ঠাতা। বিনিয়োগকারীদের থেকে প্রস্তাব উঠে আসে নতুন ক্লাবের নাম রাখা হোক ‘সিনসিনাটি এলিফ্যান্টস’। ক্লাবের নামে হাতি! এমন ‘স্থূলকায়’ নাম মোটেই পছন্দ ছিল না পেনিংটনের। কিন্তু বিকল্প কিছু নামও যে প্রস্তাব করতে হবে তাঁকে।
আরও পড়ুন
প্রয়াত ভারতীয় ফুটবলের ‘চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া’ নভি কাপাডিয়া
শেষ পর্যন্ত পেনিংটনকে দিশা দেখায় একটি মার্কিন সংস্থার বিজ্ঞাপন। ‘বেঙ্গল ফার্নেস’-খ্যাত সেই ফার্নেস কোম্পানির নাম রাখা হয়েছিল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের অনুকরণে। বিজ্ঞাপনেও স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল সেই ছবিই। বলাই বাহুল্য, তৎকালীন সময়ে অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় ভারতের বেশ দুর্নাম ছিল সর্প এবং ব্যাঘ্রের জন্য। বাংলার বাঘের ক্ষিপ্রতাকে রীতিমতো সমঝে চলতেন সাহেবরা। সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে পেনিংটন নিজের দলের নাম রাখেন ‘সিনসিনাটি বেঙ্গলস’।
আরও পড়ুন
দেশের প্রথম এলজিবিটিকিউ ফুটবল দল, নেপথ্যে মণিপুরের সাদাম
তবে খুব বেশিদিন চলেনি সেই ক্লাব। ১৯৪১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পরেই ভেঙে পড়েছিল দেশের আর্থিক অবস্থা। তখন বাধ্য হয়েই অন্য দুটি ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে জোট বাঁধে ‘সিনসিনাটি বেঙ্গলস’। মুছে যায় তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে আবার নতুন করে ‘সিনসিনাটি বেঙ্গলস’-এর প্রতিষ্ঠা করেন পল ব্রাউন নামের এক ব্যক্তি। তার নতুন জমানায় এই ক্লাব সেইভাবে ছাপ ফেলতে পারেনি মার্কিন ফুটবলে।
জন্মলগ্ন থেকে ‘সিনসিনাটি বেঙ্গলস’-এর দলের লোগোতে ছিল লাফিয়ে পড়া বাঘের ছবি। সেই লোগো পরিবর্তিত হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। একটা সময় শুধুমাত্র গর্জনরত ব্যাঘ্রের মুখ ছিল দলের লোগো। সেসব কিছুই নেই এখন। আজ বড়োহাতের ‘বি’ হরফটিই দলের প্রতীক। তবে হলুদ রঙের ওপর কালো ডোরা কাটা দাগই মনে করিয়ে দেয় বাংলার সঙ্গে এই ক্লাবের সম্পর্ককে। এভাবেই যেন বাংলা ফুটবলের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয়ে টিকে রয়েছে এই মার্কিন ফুটবল ক্লাব…
Powered by Froala Editor