পৃথিবীর থেকে ১০ গুণ ভারী, সৌরজগতেই লুকিয়ে ‘অদৃশ্য’ গ্রহ?

বছর পনেরো আগের কথা। গ্রহত্ব হারিয়ে বামনগ্রহের তালিকায় স্থান পেয়েছিল প্লুটো। শুধু প্লুটোই নয় সেরেস, এরিস, মেকমেক, হাউমি এবং সেডনাও পেয়েছিল বামন গ্রহের আখ্যা। কিন্তু এখানেই কি শেষ আমাদের সৌরজগতের পরিধি? ঠিক এই জায়গাতেই বছর কয়েক আগে নতুন করে এক রহস্যের সন্ধান দিয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল ব্রাউন এবং কনস্ট্যানটাইন ব্যাটিগিন। ২০১৬ সালে তাঁরা প্রকাশ করেন একটি বিস্তারিত গবেষণাপত্র। আর তাতে তত্ত্বের মাধ্যমেই দাবি করা হয় সৌরজগতেই রয়েছে নবম একটি গ্রহের অস্তিত্ব। বিজ্ঞানীরা এর নামকরণ করেছেন ‘প্ল্যানেট নাইন’ বা ‘প্ল্যানেট এক্স’।

শুনতে অবাক লাগছে নিশ্চয়ই? লাগারই কথা। কারণ, এখনও পর্যন্ত গবেষকরাই নিজের চোখে চিহ্নিত করে উঠতে পারেননি এই গ্রহকে। তবে কী করে বুঝলেন তাঁরা এই রহস্যময় গ্রহের উপস্থিতি? বাস্তবে একটি নয়, একাধিক প্রমাণের ভিত্তিতেই এই মডেল তৈরি করেছেন ক্যালটেকের গবেষকদ্বয়।

শুরু করা যাক ১৯৮৯-এর ভয়েজার অভিযান দিয়ে। তখন অবশ্য এই ‘প্ল্যানেট নাইন’-এর আঙ্গিকে দেখা হয়নি বিষয়টি। মহাকাশ অনুসন্ধানের অন্যতম মিশন ভয়েজার নেপচুনের কাছে পৌঁছে পাঠিয়েছিল সেখানকার তথ্য। যার সঙ্গে পূর্ব-নির্ণিত নেপচুনের ভরের তারতম্য দেখা যায়। একই ঘটনা ঘটে ইউরেনাসের সঙ্গেও তবে তা অত্যন্তই সামান্য। কিন্তু হঠাৎ এই ভর কমে যাওয়ার রহস্য সমাধান করতে ব্যর্থ হন তৎকালীন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।

পরবর্তীকালে ঠিক এই জায়গাতেই প্রশ্ন তোলেন ব্রাউন এবং কনস্ট্যানটাইন। দাবি জানান, সৌরজগতের বাইরের অংশে এমন কোনো সদস্য রয়েছে যা ক্রমাগত আকর্ষণ করে চলেছে নেপচুন এবং ইউরেনাসকে। যার কারণে প্রভাব পড়ছে এই দুই গ্রহের ভরে। এবং সামান্য হলেও সূর্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে গ্রহ দুটি। বলাই বাহুল্য প্লুটো এবং অন্যান্য গ্রহগুলির ভর অত্যন্ত সামান্য হওয়ায়, তাদের জন্য ঘটছে না এই ঘটনা।

আরও পড়ুন
সৌরজগতের মতোই নক্ষত্র ও গ্রহসমাবেশ; ২০০ আলোকবর্ষ দূরের সন্ধান দিল পড়ুয়ারা

এ তো গেল একটি কারণ, এরপর আসা যাক বামন গ্রহদের অদ্ভুত আচরণের প্রসঙ্গে। সৌরজগতের এই ছয় সদস্যের ক্ষেত্রেই দেখা যায় তাদের উপবৃত্তাকার কক্ষপথ ভীষণরকম অপ্রত্যাশিতভাবে বিকৃত। যেখানে প্রতিটি গ্রহের কক্ষপথ স্বাভাবিকভাবে গোলাকার পথ বজায় রাখার চেষ্টা করে সেখানে প্রতিটি বামন গ্রহের কক্ষপথই অনেকটা চ্যাপ্টা। সূর্য থেকে কক্ষপথের দূরবর্তী বিন্দুর দূরত্ব কয়েকশো গুণ বড়ো নিকটবর্তী বিন্দুর তুলনায়। তাছাড়াও প্রতিটি বামন গ্রহের কক্ষপথই পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহগুলির কক্ষতলের সঙ্গে ৩০-৩২ ডিগ্রি কোণে ঝুঁকে রয়েছে।

আরও পড়ুন
অফুরন্ত শক্তির উৎস হতে পারে ব্ল্যাকহোল, তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ দিল সাম্প্রতিক গবেষণা

এমন আচরণের ব্যাখ্যাও মিলে যায় ব্রাউন ও কনস্টানটাইনের তত্ত্ব থেকে। একমাত্র ভারি কোনো মহাজাগতিক বস্তুর প্রভাবেই প্রতিটি কক্ষপথ এভাবে সরে যেতে পারে একই কৌণিক ব্যবধানে। পাশাপাশি তার আকর্ষণেই দূরবর্তী বিন্দু পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে বামন গ্রহগুলির কক্ষপথ।

আরও পড়ুন
তিনটি নক্ষত্রের চারিদিকে ঘোরে একটি গ্রহ, অবাক করা আবিষ্কার নাসার বিজ্ঞানীদের

গাণিতিক সমীকরণ এবং সুপার কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে এই মডেল তৈরি করেন ক্যালটেকের এই দুই গবেষক। ২০১৬ সালে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল এই গবেষণাপত্র। তাতে দাবি করা হয়, এই নবম গ্রহের ভর পৃথিবীর ভরের প্রায় ৫ থেকে ১০ গুণ। সূর্য থেকে তার গড় দূরত্ব আনুমানিক ৪৫০ কোটি কিলোমিটার। অর্থাৎ, পৃথিবী থেকে নেপচুনের যা দূরত্ব তার থেকেও প্রায় ২০ গুণ দূরে অবস্থান করছে এই গ্রহটি। সূর্যকে  প্রদক্ষিণ করতে তার সময় লাগে অন্তত ১০ থেকে ২০ হাজার বছর। সূর্য থেকে এতদূরে অবস্থানের জন্যই তাতে সামান্যতম আলো পৌঁছায় বলে অভিমত জানান ব্রাউন। আর সেই কারণেই এই দূরবর্তী এই গ্রহকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

তবে এখানেই শেষ নয়। বছর দুয়েক বাদেই চিকাগোর ইলিনয়েস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জেমস আনউইন এবং তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জ্যাকুব স্কোলস সামান্য পরিবর্তন করেন এই তত্ত্বের। গোটা মডেল একই রেখে তাঁরা সম্ভাবনা তুলে ধরেন এই ‘প্ল্যানেট নাইন’ আদতে কোনো গ্রহ নাও হতে পারে। হয়তো তা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে থাকা কোনো প্রাইমোডিয়াল ব্ল্যাকহোল। এই ধরণের ব্ল্যাকহোলের ভর হয় সাধারণত গ্রহের তুল্য। আয়তন বড়োজোর একটা কমলালেবুর সমান। কাজেই তাদের খালি চোখে চিহ্নিত করা যায় না।

যাই হোক সৌরজগতের এই রহস্যময় সদস্যকে চাক্ষুষ করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষকরা। এমন মহাজাগতিক বস্তুর অস্তিত্ব নিয়ে এককথায় কোনো সন্দেহই নেই গবেষকদের। তবে তা গ্রহ নাকি ব্ল্যাকহোল তা নিয়ে রয়ে গেছে ধন্ধ। যদি গ্রহ হয়ে থাকে তবে হাওয়াইয়ে অবস্থিত পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী টেলিস্কোপে আগামী ৫ বছরের মধ্যেই ধরা পড়বে এই গ্রহ। এমনটাই আশ্বাস জানিয়েছেন গবেষকরা। আর যদি ব্ল্যাক হোল হয়ে থাকে তার শতাধিক বছরের অপেক্ষার পরেও অজ্ঞাত থেকে যেতে পারে সেটি। কারণ পৃথিবী থেকে পাঠানো লেসার আলোর বিক্ষিপ্ত গতিই একমাত্র প্রমাণ দিতে পারে তার। 

বিগত কয়েক বছরে সৌরজগতের বাইরের বিভিন্ন নক্ষত্রমণ্ডলের কোটি কোটি গ্রহের সন্ধান দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। অথচ আজও সৌরজগতের গঠনই ঠিক করে নির্ধারিত হয়নি, এমনটা ভাবাও কঠিন কাজ। তবে এই নবম গ্রহের অস্তিত্ব নজরে এলে আবার নতুন করে সৌরজগতের গঠন নির্ণয় করতে হবে বিজ্ঞানীদের। ২০০৬ সালের মতোই হয়তো বদলে যাবে গ্রহের সংজ্ঞাও। আর সেই দিনটার জন্যই উৎসুক হয়ে রয়েছেন গবেষকরা। উৎসুক হয়ে রয়েছেন নতুন ‘জগৎ’-এর খোঁজ পাওয়ার অপেক্ষায়…

Powered by Froala Editor