লন্ডনের রয়্যাল কোর্ট থিয়েটার সেদিন ভর্তি কানায় কানায়। শুধু ব্রিটেনেরই নয়, বিদেশেরও নানান নাট্যশিল্পীরা হাজির হয়েছে সেই অনুষ্ঠানে। ফলে দর্শকদের উত্তেজনায় কমতি নেই এতটুকু। হঠাৎ করেই শুরু হল পাথর ঠোকার আওয়াজ। হলের আলো নিভে মঞ্চ থেকে ধীরে ধীরে সরল পর্দা। অথচ, মঞ্চ আক্ষরিক অর্থেই শূন্য। সেট বলতে যা বোঝায় তার ছিটেফোঁটাও নেই মঞ্চে। শুধু দুজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ বসে পাথর ঠুকে চলেছেন। ধীরে ধীরে নিভে গেল হলের সমস্ত গুঞ্জন। শুধু পাথরের ঠক ঠক আওয়াজ হয়ে চলল প্রায় ১৪ মিনিট ধরে…
আধুনিক থিয়েটারের দুনিয়ায় পিটার ব্রুক (Peter Brook) এক কিংবদন্তির নাম। ১৯৭০-এ তাঁর ‘দ্য মিডনাইট সামার ড্রিম’ থিয়েটারের দুনিয়ায় এক নতুন মাইলফলক স্থাপন করেছিল। তাছাড়া তাঁর লেখা ‘দ্য এম্পটি স্পেস’ বিশ্বের অধিকাংশ তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালকের কাছেই বাইবেল-সম। হ্যাঁ, পিটার ব্রুকের কথাই হচ্ছে। তবে শুরুতে যে মঞ্চায়নের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা পিটারের নির্দেশনা নয়। বরং, সেদিন দর্শকাসনে হাজির ছিলেন তিনি। তবে কে এই নাটকের নির্দেশক? আর কী-ই বা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি এই মনোটনির মধ্যে দিয়ে?
সময়টা বললেই পরিষ্কার হয়ে যাবে দৃশ্যটা। সেটা ১৯৭৩ সাল। আর নাটকটির নাম ‘দ্য আইল্যান্ড’। দক্ষিণ আফ্রিকান লেখক অ্যাথল ফুগার্ডের লেখা এই নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলেন আরও দুই হতদরিদ্র দক্ষিণ আফ্রিকান শিল্পী জন কানি এবং উইনস্টোন এনৎসোনা। আর এই নাটকের নির্দেশকও তাঁরাই। সর্বস্ব বিকিয়েই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ব্রিটেনে পাড়ি দিতে হয়েছিল তাঁদের। ফলে, সেট ডিজাইনের কথা ভাবাটাও ছিল অত্যুক্তি। তবে তারপরেও লন্ডনের মঞ্চ হয়ে উঠেছিল রবেন আইল্যান্ড। দর্শকদেরও বুঝতে অসুবিধা হয়নি, মঞ্চে পাথর ঠুকতে থাকা ছায়ামূর্তি দুটির একজন আদতে নেলসন ম্যান্ডেলা। তৎকালীন সময়ে যিনি বন্দি রয়েছেন রবেন আইল্যান্ডেই।
‘প্রেক্ষাগৃহ শুধু নিস্তব্ধই হয়ে যায়নি সেদিন, ঘেমে উঠেছিলেন প্রতিটা মানুষ। অনুভব করেছিলেন হাজার সূর্যের তেজ, পেশিতে অসহ্য যন্ত্রণা…’ বছর কুড়ি আগে এক সাক্ষাৎকারে স্বয়ং এ-কথা জানিয়েছিলেন পিটার ব্রুক। নিঃসংকোচেই জানিয়েছিলেন, এই উপস্থাপনা তাঁকে নাড়িয়ে দিয়েছিল ভিতর থেকে। পরিচালকের ভূমিকায় নামার পর থেকে যে শূন্যতার খোঁজ করে চলেছিলেন তিনি, তার চেয়েও বড়ো এক শূন্যতার সামনে তাঁকে হাজির করেছিল ‘দ্য আইল্যান্ড’।
আরও পড়ুন
পৃথিবীর যে-কোনো শূন্য পরিসরই পিটার ব্রুকের নাট্য ক্যানভাস
নাট্য উপস্থাপনার প্রথাগত ধারার সঙ্গে তাঁর মতের অমিল ছিল চিরকালই। তবে এই নাটক দেখার পর তাঁর সামনে খুলে গিয়েছিল নতুন এক প্রান্তর। তাঁর কথায় তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, “লন্ডন থিয়েটার হোয়্যার এভরিথিং ওয়াজ গ্লসড ওভার ইন নেম অফ চার্ম অ্যান্ড লাইটনেস।” বরং, দর্শকদের অস্বস্তির সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়াই একজন প্রকৃত পরিচালকের দায়িত্ব।
আরও পড়ুন
বিশ্বের ইতিহাসে ‘স্মার্টেস্ট’ ক্রিকেট টিম, দলে শার্লক এবং পিটার প্যান-স্রষ্টাও
অবশ্য, এই নীতিতে পিটারের বিশ্বাস ছিল যৌবন থেকেই। ১৯৪৯ সালের কথাই ভাবা যেতে পারে। কোভেন্ট গার্ডেনে পিটার সে-বছর উপস্থাপন করেছিলেন অস্কার ওয়াইল্ডের ‘সালোমে’। সেইসঙ্গে স্ট্রসের সঙ্গীত আর সালভাদোর দালির মঞ্চসজ্জা— সবমিলিয়ে এক ভয়াবহ চেহারা নিয়েছিল সেই নাটকের প্রেক্ষাপট। আগুন ঝরিয়েছিলেন সমালোচকরা। দর্শকরাও নাক সিঁটিয়েছিলেন সেই প্রযোজনা দেখে। অন্যদিকে পিটারের বিরুদ্ধে প্রায় আন্দোলনে নেমেছিলেন খ্যাতনামা ‘সেলোমে’ অভিনেত্রী জুবা ওয়েলিচ। স্যাক করা হয়েছিল পিটারকে।
‘দ্য আইল্যান্ড’ মঞ্চস্থ হওয়ার পর পিটার আবার যেন নতুন করে মানব সভ্যতার অন্ধকার গলি-ঘুঁজিগুলোর অনুসন্ধানে নেমেছিলেন। ব্রিটেনের নাট্যজগৎ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন প্যারিসে। শুধু রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রতিবাদই নয়, রাজনীতির নানান আঙ্গিক ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন মঞ্চে। ‘লা ইকস’-ই হোক কিংবা ‘মহাভারত’— সর্বত্রই তিনি অনুসন্ধান করেছেন এক ভিন্ন রাজনীতির। কোথাও গিয়ে এক লুকনো অসহায়তারও। অস্বস্তির সামনে দাঁড় করাতে চেয়েছেন দর্শকদের।
এমনকি পিটারের জীবনে ‘দ্য আইল্যান্ড’-এর প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী ছিল যে, ২০০০ সালে তাঁর প্যারিসের মঞ্চ ‘বোফেস দু নর্ড’-এ ঐতিহাসিক নাটকটি মঞ্চস্থ করার জন্য তিনি নিজ খরচায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কানি এবং উইনস্টোনকে। অকুন্ঠভাবে ঋণস্বীকার করেছেন সংবাদমাধ্যমে। আর পাঁচজন পরিচালকের থেকে এখানেই আলাদা পিটার। যেখানে বিশ্বের তাবড় থিয়েটার-তারকারাও ‘গুরু’ বলে মেনে নেন তাঁকে অনায়াসেই, সেখানে দাঁড়িয়ে বার বার নতুন করে শিক্ষার্থীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি নিজে। ভাঙা-গড়ার মাঝেই অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন নতুনের। বিশ্বাস করেছেন, থিয়েটার কিংবা নাটকের প্রাণ আসলে অভিনেতারাই। আর পরিচালকের কাজ কেবলমাত্র তাঁদের অন্তর্সত্তার উন্মেষ ঘটানো। বিশ্বের দ্বিতীয় কোনো পরিচালক এভাবে ভেবেছেন কি? সন্দেহ আছে তা নিয়ে…
Powered by Froala Editor