চলে গেলেন প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব ইব্রাহিম আলকাজি, ভারতীয় থিয়েটার হারাল এক অভিভাবককে

২০২০। একেবারেই যে ভালো যাচ্ছে না বছরটা, তাতে সন্দেহ নেই। একের পর এক নক্ষত্রকে হারিয়েই চলেছে ভারত। এবার চলে গেলেন ভারতের থিয়েটার জগতের অন্যতম প্রাণপুরুষ ইব্রাহিম আলকাজি। মঞ্চের চাকচিক্য নয়, ক্ষুরধার ডায়লগও নয়, অভিনয়ের মূল ভিত্তিই হল চরিত্রের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা। এমনটাই মনে করতেন আলকাজি। বলতে গেলে আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের রূপরেখাই তৈরি হয়েছে তাঁর হাতে। 

বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন দীর্ঘদিন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি ভর্তি হয়েছিলেন দিল্লির এক হাসপাতালে। সেখানেই মঙ্গলবার দুপুরে মৃত্যু হয় এই কিংবদন্তির। 

জন্ম ১৯২৫ সালে ভারতের পুনেতে। তবে জন্মসূত্রে ভারতীয় নন ইব্রাহিম। বাবা ছিলেন সৌদি আরবের বাসিন্দা। মা কুয়েতের। তবে ভারতের মাটিতেই বেড়ে ওঠা তাঁর। এই দেশের সঙ্গেই তাঁর আত্মীয়তার বন্ধন। ৪৭-এ দেশভাগের সময় অন্যান্য ভাইবোন-সহ গোটা পরিবার পাকিস্তানে চলে গেলেও ভারতেই থেকে যান আলকাজি। 

পড়াশোনা করেছেন মুম্বাইয়ের জেভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকেই তাঁর শুরু অভিনয়ের পথে হাঁটা। কলেজ পাশ করেই যোগ দিয়েছিলেন মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ববি পদমসীর ‘থিয়েটার গ্রুপ’-এ। তবে খুব বেশিদিন অভিনয় করতে পারেননি এই দলের অংশ হিসাবে। ইংল্যান্ডের রয়্যাল অ্যাকাডেমি অফ ড্রামাটিক আর্টসে পড়াশোনা করতে যান ১৯৪৪ সালে। তার ঠিক তিন বছরের মাথাতেই সাফল্য। মুকুটে উঠল জোড়াপালক। বিবিসি এবং ইংলিশ ড্রামা লীগের দুটি পৃথক স্বীকৃতি। সুযোগ এসেছিল ব্রিটিশ মঞ্চ কাঁপানোর। কিন্তু লোভনীয় সেসব অফার ছেড়েই দেশের টানে ফিরে এসেছিলেন আলকাজি। ফিরে এসে আবার যুক্ত হয়েছিলেন ‘থিয়েটার গ্রুপে’।

ভারতীয় থিয়েটারকে আদ্য-প্রান্ত বদলে ফেলেছিলেন তিনি। মিশিয়েছিলেন পাশ্চাত্যের ছোঁয়াচ। তবে শুধু অভিনয় বা পরিচালনা নয়, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের থিয়েটার সংক্রান্ত যে কোনো কাজকেই মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবেই প্রতি মাসে প্রকাশ করতেন ‘থিয়েটার ইউনিট বুলেটিন’ পত্রিকা। 

মুম্বাইয়ের মতো শহরে তাঁর অভিনয় জয় করে নিয়েছিল দর্শকদের মন। মুখে মুখেই ফিরত আলকাজির নাম। অভিনয়ের পাশাপাশি অধ্যক্ষের পদ সামলেছেন বোম্বে নাট্য অ্যাকাডেমির। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্কুল অফ ড্রামাটিক আর্টসের। কিন্তু মুম্বাইয়ের মঞ্চ, ফেম, খ্যাতি ছেড়েই পরবর্তীকালে দিল্লি চলে গিয়েছিলেন আলকাজি। লক্ষ্য ছিল হিন্দি থিয়েটারের পরিবেশন, উপস্থাপনার খোলনলচে বদলে ফেলা। তুলে আনা নতুন প্রতিভাদের। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় ডিরেক্টরের পদ দায়িত্ব বহন করেছেন একটানা ১৫ বছর। যা স্কুল অফ ড্রামার ইতিহাসে দীর্ঘতম অধ্যায়। থিয়েটার এবং অভিনয় শিক্ষণের খসড়াও তৈরি তাঁর হাতেই। তাঁর হাত ধরে উঠে এসেছেন পরবর্তী যুগের অভিনয় জগতের কিংবদন্তিরা। ওম পুরী, বিজয় মেহেতা, মনোহর সিং, ওম শিবপুরী, নাসিরুদ্দিন শাহ, সুহাস জোশী, জয়শ্রীর মত হাজার তারকার নাম রয়েছে তাঁর ছাত্র তালিকায়। পরবর্তীকালে দিল্লির বুকে তৈরি করেছিলেন আর্ট হেরিটেজ গ্যালারিও। 

আরও পড়ুন
প্রয়াত অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্য হারাল আরও এক নক্ষত্রকে

অভিনয় এবং থিয়াটার জগতে তাঁর অনস্বীকার্য অবদানের জন্য ভারত সরকার পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেছিল তাঁকে। কার্যত তাঁকে ছাড়া আজকের ভারতীয় থিয়েটার অসম্পূর্ণই থেকে যেত হয়তো। আলকাজির চলে যাওয়াও শূন্যতার রেখে গেল একরাশ। শোকস্তব্ধ অভিনেতা থেকে পরিচালক সকলেই। থিয়েটারজগত হারাল তার অভিভাবককে...

Powered by Froala Editor