পরীক্ষানিরীক্ষার সঙ্গে প্রয়োজন ক্লাসিক্যালের অনুশীলনও – ‘বিসর্জন’ নাটক থেকে বার্তা থেস্‌পিয়ান্‌স্‌-এর

“নাটকে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা হবে, সেটা প্রয়োজনও। কিন্তু ক্লাসিক্যাল নাটকের অনুশীলনও প্রয়োজন, অনেক বেশি প্রয়োজন। কারণ ক্লাসিক্যাল নাটক থেকে নানাকিছু শেখা যায়।” বলছিলেন থেস্‌পিয়ান্‌স্‌ নাট্যগোষ্ঠীর সদস্য দেবাদিত্য মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি থেস্‌পিয়ান্‌স্‌-এর ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তিনদিনব্যাপী একটি নাট্যোৎসব। ২২ মার্চ তপন থিয়েটারে ‘উইটনেস’ নাটক প্রদর্শনীর মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল সেই অনুষ্ঠান। এরপর ২৭ মার্চ অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে দুটি নাটকের প্রদর্শনী – ‘রাসমনির সগগ’ এবং ‘দ্রোহপর্ব’। সব শেষে ২৯ মার্চ রবীন্দ্রসদনে প্রদর্শিত হল উৎসবের শেষ নাটক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিসর্জন’।

পর্দা ওঠার আগেই নেপথ্যে জানিয়ে দেওয়া হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই নাটকটি নিয়ে ইতিপূর্বে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা হলেও থেস্‌পিয়ান্‌স্‌ সেই পথে হাঁটেনি। তাঁদের মতে, ‘বাংলা নাট্যজগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের’ রচনায় পরিবর্তন ঘটানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না তাঁরা। নাটকের শেষে নির্দেশক পার্থ মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, “যে বিশ্বব্যাপী হিংসার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বিসর্জন নাটকের ইংরেজি অনুবাদ The Sacrifice লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই বাস্তবের কোনো পরিবর্তন তো ঘটেনি। সেটা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উদাহরণ নিয়েই যদি দেখি, হিংসা আর যুদ্ধ এখনও সারা পৃথিবীতে রয়েছে। তাই বিসর্জন নাটকটিও সবসময়ই প্রাসঙ্গিক। তাকে সময়োপযোগী করে নেওয়ার তো কিছু নেই।”

তবে ‘বিসর্জন’ লেখার সময় থেকে আজকের সময়ের মধ্যে বদল ঘটেছে নাটকের উপস্থাপনায়। তাই দেবাদিত্যবাবুও হাসতে হাসতে বলছিলেন, “বদলে নিতে পারলে আমাদেরই অভিনয় করতে সুবিধা হত।” এই নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন জয়সিংহ চরিত্রে। যার জীবনের সমস্ত দ্বিধা, দ্বন্দ্ব প্রকাশিত হয়েছে সংলাপের কাব্যিক মূর্ছনায়। সেই সংলাপগুলি সহজ গদ্যভাষায় বদলে নিতে পারলে অভিনয় সহজ হত, সেটা স্বীকার করতেই হয়। একই কথা প্রযোজ্য রঘুপতি চরিত্রের অভিনেতা শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায় এবং গোবিন্দমাণিক্য পার্থ মুখোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গেও। দীর্ঘ সংলাপগুলিতে উচ্চারণের নাটকীয়তা বজায় রেখে মঞ্চাভিনয়, সহজ নয়। তবুও এই কঠিন পথটাই বেছে নিয়েছে থেস্‌পিয়ান্‌স্‌।

আধুনিক নাটকের পাশাপাশি  থেস্‌পিয়ান্‌স্‌ বরাবরই জোর দিয়েছে ক্লাসিক্যাল নাটকের উপস্থাপনায়। এর আগেও দিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সাজাহান’  বা মনোজ মিত্র রচিত 'অশ্বত্থামা'-র মত নাটক মঞ্চস্থ করেছে তারা। নাটকের মূল গঠনে কোনোরকম পরিবর্তন না ঘটিয়েই। আবার আগাথা ক্রিস্টির কাহিনী অবলম্বনে ‘তখন কুয়াশা’ নাটকটি মঞ্চস্থ করার সময় বদলে নিতে হয়েছে গল্পের পটভূমি। কারণ সেখানে সম্পূর্ণ বিদেশি একটি কাহিনিকে বাংলার দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার তাগিদ ছিল।

১৯৯৪ সালের ১২ ডিসেম্বর জ্ঞান মঞ্চে বাদল সরকারের "যদি আর একবার" নাটকের প্রদর্শনী দিয়ে যাত্রা শুরু করে থেস্‌পিয়ান্‌স্‌। ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে ২০১৯ সালেই। এর মধ্যে অবশ্য প্রায় ১০ বছর (২০০৩-২০১৪) নানা জটিলতার কারণে থেসপিয়ান্স্-এর কর্মকাণ্ড ধীর গতিতে চলেছে। তবে পরবর্তী ৭ বছরের মধ্যে ৭টি নতুন মঞ্চ নাটক এবং ১০টির ও বেশি শ্রুতি নাটক  উপস্থিত করেছেন তাঁরা। যার মধ্যে রয়েছে নাট্যোৎসবে অভিনীত ‘উইটনেস’, ‘রাসমনির সগগ’ এবং ‘দ্রোহপর্ব’ । নাটকের কাহিনিতে কখনও সাধারণ এক মহিলার জীবনের টানাপোড়েন, কখনও আবার মহাভারতের অনুসঙ্গও মিলেমিশে গিয়েছে। উঠে এসেছে সমাজে নারীর অবস্থানের প্রসঙ্গ। “পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কিছু পরিবর্তন ঘটলেও নারীর অবস্থানের জায়গাটা যে প্রায় একই রয়েছে, সেটাই এই নাটকগুলির মধ্যে দিয়ে বলতে চেয়েছি আমরা।” বলছিলেন পার্থ মুখোপাধ্যায়।

কোভিড অতিমারীর কারণে বারবার পিছিয়ে গিয়েছে থেস্‌পিয়ান্‌স্‌-এর ২৫ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানের নির্ঘণ্ট। এর মধ্যে সারা পৃথিবীজুড়েই নাট্যকর্মীরা এক অভূতপূর্ব কঠিন সময়ের মধ্যে পড়েছেন। দেবাদিত্যবাবুর মতে, এই সময়ে সাধারণ দর্শকদের কাছে আরও বেশি বেশি করে পৌঁছে যাওয়া, তাঁদের কাছে নিজেদের উপস্থিতির কথা জানানোই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কথায়, “নাটক নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা তো সবসময়ই কোথায় কোন নাটক হচ্ছে তার খোঁজখবর রাখবেন। কিন্তু নাটকের মূল ভিত্তি তো তাঁরাই, যাঁদের আমরা সাধারণ দর্শক বলি"।

Powered by Froala Editor

More From Author See More