এমনটাও যে হতে পারে, ভাবেননি পরিমল ভট্টাচার্য বা অর্ক ভাদুড়ি। নিজের আবেগ, অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন ফেসবুকে। আর সেই ফেসবুক পোস্ট থেকেই জন্ম নিল আস্ত একটি নাটক। বা জন্ম নিল কথাটা বলাও হয়তো সম্পূর্ণ ঠিক নয়। ‘ভাঙনের পথে’ নাটকের নির্দেশক দীপঙ্কর সেন বলছিলেন, “আমরা নাট্যরূপ দিয়েছি, এমন নয় একেবারেই। ওই ফেসবুক পোস্টদুটিকেই মঞ্চে তুলে এনেছি। সেখানে একটি যতিচিহ্নও পরিবর্তন করা হয়নি।” ২০১৯ সালেই সাহিত্যিক পরিমল ভট্টাচার্যকে এই পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন দীপঙ্করবাবু। পরিমলবাবু অবাক হয়েছিলেন এমন পরিকল্পনা শুনে। অবাক হয়েছিলেন সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়িও।
অবাক হওয়ার মতোই বিষয়। এমনটা যে সচরাচর শোনা যায় না। তবে দীপঙ্কর সেন এবং তাঁর নাটকের দল ‘দুর্গাপুর ভীমরতি’ এই ব্যতিক্রমী পরীক্ষাটাই করতে চেয়েছেন। আর অনেকাংশে সেই প্রচেষ্টা সফলও হয়েছে। এমন নাটক অবশ্য এই প্রথম নয়, বলছিলেন দীপঙ্করবাবু। এর আগে দলের দ্বিতীয় প্রযোজনা ‘পাঁচকান’ নাটকটিও তৈরি হয়েছিল এমন ৫টি লেখা নিয়ে যাদের নাট্যরূপ ছিল না। তার মধ্যেও ছিল একটি ফেসবুক পোস্ট। তবে সম্পূর্ণভাবে ফেসবুক পোস্টের উপর তৈরি নাটক এই প্রথম। এই পরিকল্পনার পুরো কৃতিত্ব একা নিতে নারাজ নির্দেশক। “ছাত্রজীবনে হোস্টেলে একটি আলোচনায় উঠে এসেছিল এমন ধরনের টেক্সট, যাদের কোনো নাট্যরূপ নেই, তাদের মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা।” বলছিলেন তিনি। কে এই পরিকল্পনা প্রথম রেখেছিলেন, তা হয়তো আজ আর কারোরই মনে নেই। কিন্তু দীপঙ্করবাবু সেই পরিকল্পনাকে সার্থক রূপ দিয়েছেন।
২০১৯ সালে কলকাতা শহরে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙাকে ঘিরে একটি পোস্ট লিখেছিলেন সাহিত্যিক পরিমল ভট্টাচার্য। সেখানে নানা পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি দেখিয়েছিলেন রাজ্যের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত হচ্ছে। অন্যদিকে অর্ক ভাদুড়ির ফেসবুক পোস্টটিতে উঠে এসেছে একেবারে সাম্প্রতিক সময়ের ছবি। লকডাউনে স্কুল বন্ধ, রোজগারও বন্ধ বহু পরিবারে। পড়াশোনা ছেড়ে বহু স্কুলপড়ুয়া ঠিকাশ্রমিকের কাজে যোগ দিয়েছে। তাদেরই কয়েকজনের সঙ্গে একটি ট্রেনযাত্রার মধ্যে উঠে আসা কিছু কথোপকথন নিয়ে ছিল অর্ক ভাদুড়ির পোস্ট। বাঙালির ছদ্ম বিদ্যাসাগরপ্রেমে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর স্বয়ং ট্রেনে চড়ে রওনা হলেন। আর সেখান থেকেই যেন শুরু হল নাটকের দ্বিতীয় পর্ব। এভাবেই পুরো বিষয়টি সাজিয়েছেন নির্দেশক। নাটকটির অন্য একটি ব্যতিক্রমী দিক হল, এখানে বিদ্যাসাগরের চরিত্রে দেখা যাবে মহিলা শিল্পী নয়নাকে। “বিদ্যাসাগর তো এখানে একটি ভাবনা। তাঁকে সেই ঐতিহাসিক চরিত্রটির মতোই দেখতে হতে হবে, এমন তো কথা নেই।” বলছিলেন দীপঙ্করবাবু।
“পরিমলবাবু বা অর্কর মতো মননশীল মানুষরা সমাজের নানা ঘটনায় দুঃখ পান, ব্যথিত হন। সেখান থেকেই হয়তো একটি ফেসবুক পোস্ট লেখেন। আবার তার মধ্যে বিশ্লেষণও থাকে। এইসমস্ত বিষয়গুলি আরও মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটা দায় থেকেই যায়।” তবে পরিমলবাবুর কথায়, “আমার পোস্ট বা অর্কর পোস্ট, বা যে কোনো মানুষেরই ফেসবুক পোস্ট হোক – সেটাও তো একটা মাধ্যম। এক মাধ্যম থেকে আরেক মাধ্যমে সাহিত্যকে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে একটা মেলবন্ধন তৈরি হয়।” শুধু তাই নয়, পরিমলবাবু বলছিলেন সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে যে নানা অংশের মানুষের স্বর উঠে আসছে, তাদেরও একটা জায়গা করে দেওয়া ভীষণ জরুরি। অর্কও বলছিলেন, “নাটকের দর্শক হিসাবে আমি বলতে পারি, মানুষের খুব কাছের অনুভূতিগুলো স্পর্শ করতে পারে এমন উদ্যোগ।”
৫ সেপ্টেম্বর দরজা বন্ধ মঞ্চে প্রথম প্রদর্শনীর পর এখনও পর্যন্ত আরো দুটি প্রদর্শনী হয়েছে নাটকটির। আগামী ৭ নভেম্বর উষা গাঙ্গুলি মঞ্চে আবারও প্রদর্শিত হবে ‘ভাঙনের পথে’। এই মাসেই রয়েছে আরও দুটি প্রদর্শনী। ডিসেম্বর, জানুয়ারি মাসেও বেশ কিছু জায়গায় অনুষ্ঠিত হবে নাটকিটি। ইতিমধ্যে দর্শকদের মধ্যে সাড়া জাগাতে শুরু করেছে ‘ভাঙনের পথে’। পরীক্ষামূলক এই উদ্যোগ দর্শকদের ভালো লাগছে, এর থেকে বড়ো আর কী হতে পারে?
Powered by Froala Editor