তাঁর হাত ধরেই হিন্দি নাটকে অভ্যস্ত হয়েছিল বাঙালি, উষার প্রয়াণে শেষ হল একটি অধ্যায়

এই বছরই ছিল তাঁর নাট্যজীবনের পঞ্চাশতম বর্ষ। একের পর এক স্মরণীয় নাটকে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন আপামর দর্শককে। শুধু দর্শক কেন, তাঁর সতীর্থরাও বারবার গর্বের সঙ্গে মনে করেন সেই অভিনয়সত্তাকে। বাংলা তো বটেই, গোটা ভারতে তিনি ছিলেন অন্যতম একটি নাম। ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলার মঞ্চ ও দর্শকদের সঙ্গে যিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন হিন্দি নাটকের। লকডাউনের এই আতঙ্কের আবহেই সম্প্রতি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।

আরও পড়ুন
কফিশপের মধ্যেই অভিনয়, কলকাতায় থিয়েটারের নতুন সংজ্ঞা বুনছে এই নাট্যগোষ্ঠী

হিন্দি নাটকই মূলত করতেন। জন্মসূত্রেও বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। কিন্তু তাঁর কথা শুনলে সেসব কিছুই মনে হত না। আদ্যোপান্ত বাঙালি বলতে যা বোঝায়, তা-ই ছিলেন। নাটকের জগতে নিজের দৃঢ় স্থান তৈরি করা ঊষা অবশ্য কোনোদিনও ভাবেননি রঙ্গমঞ্চে উঠতে পারবেন। জন্মেছিলেন রাজস্থানের যোধপুরে। তাঁর পরিবার ছিল উত্তরপ্রদেশের। অন্যান্য সাধারণ পরিবারের মতো, তাঁর পরিবারও ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল। মেয়েদের অত নাটক করতে হবে না। বরং মা তাঁর হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন নাচের স্কুলে। সেখান থেকে ভারতনাট্যম শেখা। কি অদ্ভুত সমাপতন না! নাচের ঘরানাটির সঙ্গেও জুড়ে আছে নাটক।

আরও পড়ুন
একটি ছবি, একটি সত্যি আত্মহত্যা এবং উনিশে এপ্রিল

এই মিলটা ঊষা নিজে খেয়াল করেছিলেন কিনা, জানা যায় না। অবশ্য জীবন নিজেই তো বড়ো মঞ্চ। কত সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে সেখানে। সেই জীবনকেই ভরসা করেছিলেন তিনি। ঊষার নিজের তৈরি করা ‘স্টুডিও থিয়েটার’-এর কথাই ধরা যাক। তাঁর নিজের দল, ‘রঙ্গকর্মী’র জায়গা। ওই জগতে ঢুকলেই মনে হবে, এ এক স্বপ্নের জায়গা। মুখের ওপর ঘন লাইট পড়ছে। যেন এক্ষুনি কেউ আউরে উঠবেন শেক্সপিয়র। লোকজন আসছে, নাটক দেখছে, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক; যেন জমজমাট পরিবেশ। এমনটা বাংলা খুব কম দেখেছে। এই দলটিকে নিজের হাতে করে তৈরি করেছিলেন ১৯৭৬ সালে। তারপর অনেক স্বপ্ন দেখা, অনেক স্বপ্ন পূরণ হওয়া।

আরও পড়ুন
একসঙ্গে অভিনয় করেও ‘অচেনা’, ঋত্বিক ঘটককে তাড়িয়ে দিলেন উৎপল

কলকাতাই তাঁর বড়ো হওয়ার শহর। এখান থেকেই পড়াশোনা, বাংলার সঙ্গে নিজেকে গড়ে নেওয়া। শ্রী শিক্ষায়তন কলেজ থেকে হিন্দি সাহিত্য নিয়ে মাস্টার্স পাশ করেন। তারপর শুরু হয় শিক্ষিকা হিসেবে তাঁর কর্মজীবন। একই সঙ্গে নাটকের মঞ্চেও যাত্রা শুরু করেন তিনি। প্রথম নাটকেই বসন্তসেনার ভূমিকায় নামেন, ‘মৃচ্ছকটিক’ অবলম্বনে তৈরি হিন্দি নাটক ‘মিট্টি কি গাড়ি’-তে। একে একে এম কে আনভাসে, তৃপ্তি মিত্র, মৃণাল সেনদের সংস্পর্শে আসেন। তাঁদের থেকেই অভিনয়, নাটকের যাবতীয় জিনিস শেখা। সেই সঙ্গে আগ্রহ ভরে দেখতে থাকেন পরিচালনার কাজ। বাংলা ভাষা, তার সংস্কৃতিকে আপন করে নেন। তারপর, শিক্ষকতার সঙ্গে অভিনয় ও মঞ্চ নির্দেশনাও চলতে থাকে সমানভাবে।

আরও পড়ুন
তৈরির ২৫ বছর পর মুক্তি পেয়েছিল প্রথম ছবি, নিজেকে ‘ফ্লপ ডিরেক্টর’ বলতেন ঋত্বিক

তৃপ্তি মিত্রের ‘গুড়িয়া ঘর’ নাটকে ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিনয় তাঁকে এনে দেয় সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। বারবার তাঁর বলিষ্ঠ ভঙ্গি উঠে এসেছে মঞ্চে। সমাজের নিচুশ্রেণীর মানুষের কথা বারবার বলতেন তিনি। বাংলার বুকে হিন্দি থিয়েটারকে আরও দর্শকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকা মনে রাখার মতো। এই ব্যাপারে তাঁকে অন্যতম পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। অন্যদিকে বাংলার সাহিত্য, নাটক সমস্ত কিছুকে নিয়ে গিয়েছিলেন ভারত ও বিশ্বের বড়ো মঞ্চে। ১৯৯৮ সালে সার্বিক অবদানের জন্য ভারত সরকারের সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কারেও ভূষিত হন ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন
সত্যজিতের সঙ্গে গেছেন বার্লিনে, ছোটোদের জামা পরে বেরিয়ে এলেন রবি ঘোষ

তবে তাঁর এবং ‘রঙ্গকর্মী’র করা একটি নাটকের কথা উল্লেখ করতেই হবে। রুদালি— ১৯৯২ সালে প্রথমবার মঞ্চস্থ করেন এই নাটক। মূল টেক্সটটি মহাশ্বেতা দেবীর। পরবর্তীতে আরও অনেক জায়গায় এই নাটকটি ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৬ সালে পাকিস্তানের লাহোরের ‘পাঞ্জ পানি ফেস্টিভ্যাল’-এ এই নাটকটি নিয়ে যান তাঁরা। উল্লেখ্য, ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রঙ্গকর্মী’ই বাংলা এবং ভারতের একমাত্র দল, যারা জার্মানির স্টুটগার্টের থিয়েটার ডের ওয়েল্ট ফেস্টিভ্যালে যোগ দিয়েছিলেন। যা একটি বিরাট সম্মান।

এ তো গেল জীবনের কথা, কীর্তির কথা। কিন্তু ঊষা গঙ্গোপাধ্যায় কি শুধু এতেই থেমে থাকবেন? এতগুলো বছর ধরে চলা তাঁর যাবতীয় কাজ, বাংলা ও হিন্দি নাটককে নিয়ে নিরন্তর প্রচেষ্টা, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের আওয়াজকে সব জায়গায় পৌঁছে দেওয়া— আরও কত কাজ বাকি ছিল! কলকাতায় একটাও কেন মেয়েদের নামে থিয়েটার মঞ্চ নেই! এই ব্যাপারটা তাঁর খারাপ লাগত। তাই নিজের ‘স্টুডিও থিয়েটার’-কে উৎসর্গ করেন দুই কিংবদন্তি মহিলা নাট্যশিল্পীর নামে। কেয়া চক্রবর্তী, এবং অবশ্যই নটী বিনোদিনী। এই দুজনেই যে ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়ের আদর্শ! একটি ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, “আমি না থাকলে কী হবে; আমার দলের বাকিরা এই পুরোটা তৈরি করে নিয়ে যাবে।” সেই দিনটা এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে কে জানত! বয়স তো হয়েছিল ৭৫ বছর। আরও কত সময় দিতে পারতেন। একটা হৃদরোগ এসে থামিয়ে দিল সব।

More From Author See More