বয়স প্রায় ৩০ বছর। তবে তাঁর আচরণ দেখে বোঝার উপায় নেই। আর পাঁচজনের মতো কথাবার্তা বলতে পারলেও, তাঁর বাচনভঙ্গির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এক অদ্ভুত টান। সেইসঙ্গে একা থাকলে কখনও কুকুরের মতোই ঘেউ ঘেউ করে ডেকে ওঠেন এই ভদ্রমহিলা। এমনকি চার হাত-পায়ে হেঁটে বেড়ান বাড়ি জুড়ে।
এই আশ্চর্য চারিত্রিক বর্ণনা যেন মনে করিয়ে দেয় ‘আরণ্যক’-এর কুকুরমানবীর কথা। না, এই গল্প কোনো অলৌকিক শক্তির নয়। বরং, এমন এক শিশুর, যাকে লালন-পালন করে বড়ো করে তুলেছে একদল কুকুর (Pack of Dogs)! অনেকটা ‘জঙ্গল বুক’-এর মোগলির মতোই।
অক্সানা মালয়া (Oxana Malaya)। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপট যে খেরসন, সেই খেরসনের ওব্লাস্টের নোভা ব্লাগোভেশচেনস্কে শহরে জন্ম অক্সানার। ১৯৮৩ সালের ৪ নভেম্বর। জন্মতারিখ দেখে অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠতে পারে, একদল সারমেয়র সঙ্গে বেড়ে উঠলেও কীভাবে প্রকাশ্যে এল তার জন্মতারিখ?
শুরু থেকেই বলা যাক এই কাহিনি। আসলে জন্মলগ্ন থেকেই অনাথ ছিলেন না অক্সানা। বরং, তাঁর বাবা-মা আলেকজান্ডার মালি ও ভ্যালেন্টিনা মালয়া দুজনেই ছিলেন মদ্যপ। তিন বছর বয়স পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গেই বসবাস করেছেন অক্সানা। তবে জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই ক্রমাগত অবহেলার শিকার হন তিনি। যার ফলস্বরূপ, কনকনে শীতের রাতে খাবারের খোঁজে বাড়ি থেকে বাইরে যেতে হয়েছিল ৩ বছর বয়সি ছোট্ট শিশুটিকে। আশ্চর্যের বিষয় হল, নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে জেনেও পরবর্তীতে কোনো অনুসন্ধান করেননি তাঁর বাবা-মা।
অন্যদিকে অক্সানা আশ্রয় নিয়েছিলেন নিকটবর্তী একটি পরিত্যক্ত বাগান বাড়ির কেনেলে। সেখানেই একদল কুকুর ‘দত্তক’ নেয় তাঁকে। হয়ে ওঠে তাঁর পরিবার। এই কুকুরের দলটির সঙ্গেই দীর্ঘ পাঁচ বছর কাটিয়েছেন তিনি। চার হাত-পায়ে হাঁটা, ঘেউ ঘেউ করে ডাকা কিংবা জিভ দিয়ে নিজের শরীর পরিষ্কার করা— স্বাভাবিকভাবেই কুকুরের বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে বিকাশ পায় তাঁর মধ্যে।
১৯৯১ সাল। প্রথম স্থানীয় কিছু মানুষের নজরে আসে এই আশ্চর্য বিষয়টি। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে খবর পৌঁছালে তাঁরা এসে উদ্ধার করেন অক্সানাকে। তবে খুব একটা সহজ ছিল না এই প্রক্রিয়া। প্রথমত অক্সানাকে উদ্ধার করতে যেতে, উদ্ধারকারীদের আক্রমণ করে কুকুরের দলটি। পাশাপাশি অক্সানা নিজেও হয়ে উঠেছিলেন বেশ হিংস্র। বন্যস্বভাব বলা যায় যাকে।
অবশেষে শেষ পর্যন্ত তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় ইউক্রেনের একটি অনাথ আশ্রমে। সমবয়সি শিশুদের থেকে মানসিক দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও, ধীরে ধীরে দু’পায়ে হাঁটতে শেখেন অক্সানা। শিখেছিলেন কথা বলতে। তবে কুকুরের কিছু কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকেই যায় তাঁর মধ্যে। উল্লেখ্য, ইউক্রেনের এই অনাথ আশ্রমের দৌলতেই সন্ধান মিলেছিল তাঁর বায়োলজিক্যাল বাবা-মায়ের। অবশ্য তাঁর বাবা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেও, কোনোদিনই নিজের চোখে মাকে দেখেননি তিনি।
২০০৬ সালে একটি তথ্যচিত্রের জন্য শিশু মনোবিজ্ঞানী লিন ফ্রাই সাক্ষাৎ করেছিলেন অক্সানার সঙ্গে। তখন তাঁর বয়স ২৩ বছর। ফ্রাই-এর অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, তখনও স্নানের পর মাথা ঝাঁকিয়েই চুল ঝাড়েন তিনি। বাড়তি খাবার দেওয়া হলে, তা কুকুরের মতো লুকিয়ে রাখেন বাড়ির আনাচে-কানাচে। তাছাড়া একা থাকলে কুকুরের মতোই সুর করে কাঁদেন তিনি। ফ্রাই-এর মতে, কুকুরের সঙ্গে বড়ো হয়ে উঠার পর হঠাৎ করে মানবসভ্যতায় ফিরে আসা তখনও সম্পূর্ণভাবে মানিয়ে নিতে পারেননি তিনি। অবচেতন মনে তাঁর গভীরভাবেই দাগ রেখে গেছে ‘সারমেয় জীবন’-এর স্মৃতি। তাই মানুষের থেকে কুকুরের সঙ্গেই সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করেন তিনি। এমনকি খুব সহজেই মিশে যেতে পারেন তাদের সঙ্গে। ভাব বিনিময় করতে পারেন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে।
লিন ফ্রাই-এর দৌলতেই আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিত পেয়েছিল অক্সানার গল্প। পরবর্তীতে ব্রিটিশ চ্যানেল-৪, রাশিয়ার টেলিভিশন চ্যানেল ‘এনটিভি’ এবং পর্তুগিজ সংবাদমাধ্যম ‘এসআইসি’-ও তথ্যচিত্র নির্মাণ করে অক্সানার ওপর। সেখানে দেখা গিয়েছিল তাঁর বায়োলজিক্যাল বাবা আলেকজান্ডার, সৎ মা এবং সৎ ভাইকেও। ২০১৩ সালে শেষবার ইউক্রেনের জাতীয় টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেন অক্সানা। এর বছর তিনেক পর প্রকাশ্যে এসেছিল আরও একটি খবর। ৩৪ বছর বয়সি অক্সানাকে নাকি স্থানান্তরিত করা হয়েছে একটি নিউরোসাইকিয়াট্রিক বোর্ডিং স্কুলে। সেখানেই গবাদি পশুদের দেখভাল করেন তিনি। এমনকি ইউক্রেন সরকার তাঁর জন্য ব্যবস্থা করেছিল মাসিক পেনশনেরও।
তারপর কেটে গেছে আরও ৬টি বছর। তবে আন্তর্জাতিক বা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে আর কোনো খোঁজ মেলেনি ‘কুকুরমানবী’ অক্সানার। চলতি বছরের শুরুতেই বেজে উঠেছিল যুদ্ধের ডঙ্কা। এমনকি খেরসন অধিগ্রহণ করেছে রুশ বাহিনি। এই ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি কেমন আছেন তিনি— তা জানা নেই কারোরই…
Powered by Froala Editor