প্রয়াত ইউরেনিয়াম-বিরোধী আন্দোলনের ‘জননী’ কং-স্পিলিটি, শেষ হল মেঘালয়ের একটি অধ্যায়

মেঘালয়ের পশ্চিম খাসি পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট গ্রাম দোমিয়াসিয়াত। গ্রাম ছোটো। আরও ছোটো সেখানে মানুষের জীবনের পরিধি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মসূচি যেন থমকে গিয়েছে এখানে এসে। অথচ এই গ্রামের নিচেই নাকি চাপা পড়ে আছে এক বিরাট ইউরেনিয়ামের সম্ভার। আর তার সন্ধান পাওয়ায় হঠাৎ যেন ভাগ্য খুলে যেতে চলেছিল দোমিয়াসিয়াতের মানুষের। কিন্তু না, প্রতিটা মানুষের জীবনে যদি অর্থই একমাত্র উদ্দেশ্য হত, তাহলে পৃথিবীটা এতদিনে সত্যিই প্রাণহীন হয়ে উঠত। অর্থের আগে জীবনকে গুরুত্ব দিতে শিখেছিলেন দোমিয়াসিয়াতের গরিব আদিবাসীরা। আর যে মানুষটি তাঁদের এই শিক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁর নাম কং-স্পিলিটি লিন্ডো লাংগ্রিন। প্রচারের আড়ালে থাকা সেই লড়াকু মানুষটি প্রয়াত হলেন বৃহস্পতিবার। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর।

২০০৭ সালে দোমিসিয়াত গ্রামে প্রথম ইউরেনিয়ামের সন্ধান পান অনুসন্ধানকারীরা। ২০০৯ সালে সেখানে খননকার্য শুরু করার অনুমতি পেল ইউরেনিয়াম কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া। কিন্তু সরকারের অনুমতি পেয়েও কোনো লাভ হল না। জমি পরীক্ষা করতে এসেই বিপাকে পড়লেন ইঞ্জিনিয়াররা। সবার আগে দা হাতে এগিয়ে এলেন এক অশীতিপর বৃদ্ধা। ছুটতে ছুটতে চিৎকার করছেন নিজস্ব ভাষায়। যার অর্থ, ‘ডাকাত’। সেদিন কং-স্পিলিটির এমন ব্যবহারে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সকলেই। তবে ক্রমশ তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন পরিবেশকর্মীরা। পাশে দাঁড়াল মেঘালয়ের পড়ুয়া সমাজও। দেখতে দেখতে গ্রামের সকলেই তাঁদের জমি লিজ দিতে অস্বীকার করলেন। ইউসিআই আধিকারিকরা বুঝেছিল, কং-স্পিলিটিকে বাগে আনতে পারলেই কাজ সহজ হবে। তাঁকে ৩০ বছর ধরে বার্ষিক ১.৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও জানায় কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ মোট মূল্য দাঁড়ায় ৪৫ কোটি। জীবনের শেষ পর্বে যে মানুষটির আর কোনো অভাব থাকত না, সেকথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তাতেও রাজি হলেন না কং-স্পিলিটি। স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, অর্থের বিনিময়ে তাঁর স্বাধীনতা, তাঁর ভিটেমাটি কেনা সম্ভব নয়।

লড়াই চলেছিল দীর্ঘ ৭ বছর। ততদিনে ইউরেনিয়াম খনির ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে সারা বিশ্বে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। জাদুগোড়ার সমস্ত মানুষ ততদিনে সেই ক্ষতিকর প্রভাবে শিকার। সেখানে প্রতিটা নতুন শিশু জন্মাচ্ছে বিকলাঙ্গ অবস্থায়। অনেক চেষ্টা করেও জাদুগোড়ার খবর চেপে রাখতে পারেনি ইউরেনিয়াম কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া। ফলে শেষ পর্যন্ত খাসি পাহাড়ে ইউরেনিয়াম খনির অনুমতি প্রত্যাহারে বাধ্য হল কেন্দ্রীয় সরকার। তবে কং-স্পিলিটি আর তাঁর সহযোদ্ধাদের লড়াই অবাক করেছিল সারা দেশকে। দোমিয়াসিয়াতের মানুষ তাঁকে ডেকেছিলেন ‘মা’ বলে। কং-স্পিলিটির মৃত্যুতে সত্যিই মাতৃহীন হল খাসি পাহাড়।

ছবি ঋণ - Tarun Bhartiya

Powered by Froala Editor

Latest News See More