বয়স কমপক্ষে হাজার বছর। উচ্চতা ২০৫ ফুট। পরিধি প্রায় ৪৫ ফুট। কথা হচ্ছে আমেরিকার ‘কিংবদন্তি’ মহীরুহ লুনাকে (Luna The Tree) নিয়ে। আমেরিকার স্ট্যাফোর্ডে অবস্থিত এই প্রাচীন রেডউড (Redwood Tree) গাছটিতেই ‘বাসা’ বেঁধেছিলেন এক মার্কিন যুবতী। জুলিয়া বাটারফ্লাই হিল (Julia Butterfly Hill)। প্রায় দু’বছর এই গাছই ছিল তাঁর আবাসস্থল।
ভাবছেন বুঝি ট্রি-হাউস নির্মাণ করেছিলেন তিনি? না, একেবারেই তেমনটা নয়। বরং, ৬ ফুট বাই ৮ ফুটের ছোট্ট কাঠের মঞ্চ বানিয়ে, তার ওপরেই একটানা প্রায় দু’বছর কাটিয়েছেন জুলিয়া। কিন্তু এমন উন্মত্ততার কারণ কী?
সেই গল্পে যাওয়ার আগে জুলিয়ার পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। জুলিয়া পেশায় ট্যাক্স অ্যাডভোকেট। অর্থাৎ, আয়কর বিভাগের আইনজীবী। তবে তাছাড়াও সক্রিয় পরিবেশকর্মী তিনি। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই মার্কিন মুলুকে একাধিক পরিবেশ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন জুলিয়া। বিশ শতকের শেষলগ্নে, আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে ১৯৯৭ সালে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে লুনার ভাগ্য। স্ট্যাফোর্ডের কয়েক একর জমির লিজ নেয় মার্কিন সংস্থা ‘প্যাসিফিক লাম্বার কোম্পানি’। মূলত, বাজারে কাঠের যোগান দেয় এই সংস্থাটি। স্বাভাবিকভাবেই তাদের দৃষ্টি পড়েছিল লুনার ওপরে। লুনাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে একপ্রকার বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছিল সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি।
তাদের সেই অমানবিক কর্মকাণ্ডেই বাধা হয়ে দাঁড়ান জুলিয়া। শুরু করেন আন্দোলন। তবে মৌখিক আন্দোলন, বিক্ষোভ, প্রতিবাদে লাভ হয়নি খুব একটা। আইনি পদক্ষেপ নেওয়ারও উপায় ছিল না কোনো। গোটা অঞ্চলটাই যে লিজে কিনে নিয়েছে সংস্থাটি। শেষ পর্যন্ত এই অসাধু উদ্যোগ ঠেকাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন জুলিয়া। ঠিক করে এই গাছেই ঘর বাঁধবেন তিনি। হলও তেমনটাই। ১৯৯৭ সালের ১০ ডিসেম্বর গাছের ১৮০ ফুট উচ্চতায় মোটা ডালে মাচা বাঁধলেন জুলিয়া। সেখানেই তাঁবু খাঁটিয়ে তৈরি হল মাথা গোঁজার ঠাঁই। সরঞ্জাম বলতে ছিল সৌরশক্তি চালিত আলো, রেডিও এবং একটি টেলিফোন। বাকি প্রয়োজনীয় সামগ্রী, খাবার-দাবার— সবই তাঁকে এনে দিত তাঁর সহযোদ্ধারা।
আরও পড়ুন
তেলেঙ্গানা বেঙ্গলি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ৬টি পুরস্কার জিতে নিল ‘দুধ পিঠের গাছ’
না, পরবর্তী দু’বছর জুলিয়াকে কেউ-ই সরাতে পারেনি লুনার কোল থেকে। আর জুলিয়ার ছত্রছায়া থেকে লুনাকে। ঝড়-বৃষ্টি, শৈত্যপ্রবাহ— সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগকেই হার মানিয়েছিলেন মার্কিন আইনজীবী। একাধিকবার সম্মুখীন হয়েছেন প্রাণনাশের হুমকির। কখনো আবার সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কর্মীরা এসে বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন জুলিয়ার বিরুদ্ধে। তবে অবিচল ছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
একই গাছে পাঁচবার ধানের ফলন! অভিনব আবিষ্কার বাংলাদেশের বিজ্ঞানীর
শেষ পর্যন্ত ৭৩৮ দিন পর জুলিয়ার কাছে হার স্বীকার করে লগিং কোম্পানিটি। মধ্যস্থতা হয় অন্যান্য গাছ কাটা হলেও, অক্ষত থাকবে লুনা। তবে বছর কয়েকের মধ্যেই বিশ্বাসঘাতকতা করে সংস্থাটি। ২০০০ সালের নভেম্বর মাসে জুলিয়ারই এক সহকর্মী আবিষ্কার করেন, লুনার গায়ে বেশ ভয়ঙ্কর এক ক্ষতচিহ্ন তৈরি হয়েছে। বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে কেউ যেন কাটার চেষ্টা করেছে তাঁর প্রশস্ত গুঁড়ি। গুঁড়ির প্রায় অর্ধেকেরও বেশি গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত সেই ক্ষতচিহ্ন। অর্থাৎ, বড়ো কোনো ঝড়ের সম্মুখীন হলেই গোড়া থেকে ভেঙে পড়তে পারে বিশালাকার মহীরুহটি।
আরও পড়ুন
গাছে ‘পরিণতি’ পাবে মৃতদেহ! তৈরি হল জৈব কফিন
খবর পাওয়ার পরেই দ্রুত পদক্ষেপ নেন জুলিয়া। ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়ে, এক মার্কিন নির্মাণ সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। লোহার পাত দিয়ে বেঁধে ফেলা হয় লুনার গুঁড়িটি। সেইসঙ্গে একাধিক গাছের ভেঙে পড়া আটকাতে চারদিকে লাগানো হয় ইস্পাতের বিম। না, মারা যায়নি লুনা। বেশ কয়েক বছরের চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সেরে ওঠে লুনা। বর্তমানে স্বমহিমাতেই বিরাজমান সহস্রাব্দপ্রাচীন এই মহীরুহ।
আশির দশকে ভারত তো বটেই, গোটা বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিল উত্তরাখণ্ডের চিপকো আন্দোলন। বৃক্ষচ্ছেদন ঠেকাতে সন্তানস্নেহে জড়িয়ে ধরেছিলেন গাছের গুঁড়ি। লুনার মৃত্যু রোধ করতে জুলিয়ার উদ্যোগও যেন মনে করিয়ে দেয় সেই কথাই। এবং কী আশ্চর্য সমাপতন, উভয়ক্ষেত্রেই গাছের রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মহিলারা…
Powered by Froala Editor